/একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দলের ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত, মনে করে বিএনপিও

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দলের ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত, মনে করে বিএনপিও

ঢাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি (হি.স.) : একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং গণহত্যায় অংশগ্রহণের কারণে জামায়াতে ইসলামির ক্ষমা চাওয়ার যে দাবি উঠেছে, তা বিএনপিও নীতিগতভাবে সমর্থন করে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বুধবার বলেছেন, ১৯৭১ সালের ভূমিকা নিয়ে জামায়াতের ক্ষমা চাওয়ার দাবি যুক্তিসঙ্গত।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দলের ভূমিকার সমালোচনা করে গত শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক জামায়াতকে ক্ষমা চাওয়া ও দল বিলুপ্ত করার পরামর্শ দিয়ে লন্ডন থেকে পদত্যাগ পাঠান | এর পর জানা যাচ্ছে জামায়াতের ভেতরেই অনেকে রাজ্জাকের মত সমর্থন করেন, সে অবস্থায় বিএনপিও এখন সরাসরি বলছে, জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত। অথচ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং গণহত্যায় অংশগ্রহণকারী জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ঘরেবাইরে তাদের অনেক বিরূপ সমালোচনা মুখোমুখি হতে হয়েছে গত দুদশক ধরে। বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে জোট গড়ে রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামি ও মুজাহিদের হাতে মন্ত্রিত্ব তুলে দিয়েছিল।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়ায় দেশজুড়ে ধিক্কার উঠেছিল। কিন্তু বিএনপি নেতা, যিনি এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে লন্ডন থেকে দায়িত্ব পালন করছেন সেই তারেক রহমান তখন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, বিএনপি ও জামায়াত দুই ভাই। তাদের কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। রাজনীতির ময়দানে অনেক জল গড়িয়ে যাওয়ার পর এখন বিএনপি বলছে, জামায়াত ক্ষমা চেয়ে বিষয়টির মীমাংসা করে ফেলুক, তা তারা চায়।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান আজ বলেছেন, ১৯৭১ সালের ভূমিকা নিয়ে জামায়াতের ক্ষমা চাওয়ার দাবি যুক্তিসঙ্গত। তিনি আরও বলেন, যারা গণতন্ত্র হত্যা করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি। আজ সকালে রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানো শেষে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম খান এই মন্তব্য করেন।

১৯৭১ সালের ভূমিকা নিয়ে জামায়াতের ভেতর থেকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি উঠেছে, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নজরুল ইসলাম খান বলেন, এই দাবি তো সবার। জামায়াত স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। এ জন্য তাদের দুঃখ, লজ্জা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। এটা যেমন যুক্তিসংগত দাবি, তেমনি আরও যুক্তিসংগত দাবি আছে। স্বাধীনতার বিরোধিতা যারা করেছে, অবশ্যই তাদের শাস্তি ও বিচার চাই।
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকের মনোভাবে দেখা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে জামায়াতকে নিয়ে দলটির ভেতরে-বাইরে যে বিতর্ক উঠেছে, তা নিয়ে তারা স্বস্তিবোধ করছেন। এতোদিন তারা প্রকাশ্যে বলতে পারেননি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কারণে। একই সঙ্গে ২০-দলীয় জোটে আর সক্রিয় না থাকার ব্যাপারে জামায়াত যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতেও স্বস্তি এসেছে তাদের মধ্যে।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক ইসলামি দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামিকেও নিষিদ্ধ করেন। একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও নিষিদ্ধ করেন।

জামায়াতের আমির গোলাম আজমসহ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সহযোগী অনেক ইসলামি নেতার নাগরিকত্ব বাতিল করেন। ওরা অবশ্য ন‘মাসের যুদ্ধশেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণের আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে জামায়াতসহ সহ ইসলামি দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। সামরিক আদেশে সংবিধানের চার মূল নীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়ে দেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। এরপরই গোলাম আজমরা দেশে ফিরে আসেন, আবার দল সংগঠিত করেন। জিয়াউর রহমান সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠা করেন বিএনপি। এর পরই যে পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, সেই পাকিস্তানের রাজনীতিরই পুনরুজ্জীবন ঘটে বাংলাদেশে। বিএনপি ও জামায়াতের গাঁটছড়ার পেছনে রয়েছে সেই ইতিহাস।
একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে আছে জামায়াত। এই বিতর্কে তারা ছায়া পেয়েছে বিএনপির। কিন্তু ইতিমধ্যে সেই নিজামি ও মুজাহিদ, যাদের হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়েছিল বিএনপি, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসি হয়েছে। ফাঁসি হয়েছে দলের প্রথম সারির আরও অনেক নেতার। গত শুক্রবার জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা আবদুর রাজ্জাক একাত্তর প্রশ্নে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং জামায়াতের বিলুপ্তিসহ আরও কিছু কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করার পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমানের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য জাতির কাছে জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত। এ ব্যাপারে আবদুর রাজ্জাক যা বলেছেন, আগেই তা বলা উচিত ছিল। আমার বিশ্বাস কথাগুলো বিএনপিও আনুষ্ঠানিকভাবে বলবে। তা না হলে বিএনপিকেও একদিন তার জন্য অনুতপ্ত হতে হবে।