BRAKING NEWS

নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা, দাবি পার্বত্য নেতা ঊষাতন তালুকদারের

বাসুদেব ধর (ঢাকা), ১৬ ফেব্রুয়ারি (হি.স.): পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অন্যতম শীর্ষ নেতা ঊষাতন তালুকদার বলেছেন, গত চার দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। নিজ বাসভূমি থেকে তাদের বিতাড়িত করে বহিরাগতদের নিয়ে এসে এখানে পুনর্বাসিত করার সুদূপ্রসারী এই লক্ষ্য যদি অব্যাহত থাকে, তবে অচিরেই আদিবাসীরা এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। তাঁর আশংকা, নিজ ভূমে পুরোপুরি পরবাসী হবেন তারা।


হিন্দুস্থান সমাচারের সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি ঊষাতন তালুকদার তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবন ও খাগড়াছড়ির চিত্র তুলে ধরে বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এই পার্বত্য ভূমিতে আদিবাসী স্থানীয়দের সংখ্যা ছিল ৯৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২৪ বছর পাকিস্তনি শাসনে ১৯৭১ সালে এই সংখ্যা নেমে আসে ৭৫ শতাংশে। বহিরাগত মুসলমানদের এখানে এনে পুনর্বাসিত করার ফলে বর্তমানে রাঙামাটিতে আদিবাসীদের সংখ্যা নেমে এসেছে ৫১ শতাংশ, বহিরাগত ৪৯ শতাংশ, বান্দরবনে স্থানীয় ৪৫ শতাংশ, বহিরাগত ৫৫ শতাংশ এবং খাগড়াছড়িতে প্রায় সমান সমান। বান্দরবন থেকে স্থানীয়দের উৎখাত করে বিতাড়নের প্রবণতা এখন ব্যাপক।তালুকদারের অভিযোগ, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের একটা বড় অংশ আদিবাসীদের বিতাড়ন করে আরও বহিরাগতদের এনে পার্বত্যভূমিতে পুনর্বাসিত করতে চায়। এই লক্ষ্যে মিথ্যা মামলা, অস্ত্র হাতে গুঁজে দিয়ে মামলা দায়ের, তল্লাশি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অনেক কর্মী ও সমর্থককে এ কারণে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষও দিনে-রাতে যে কোন সময়ে বাড়িঘরে ও ব্যক্তিগতভাবে তল্লাশির ভয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যথাযথভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিজেদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বাজারজাত করার ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছে।


ঊষাতন তালুকদার বলেন, দীর্ঘ সংঘাত শেষে ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য শান্তি চুক্তির চেতনা ছিল স্থানীয় আদিবাসীদের শাসনতান্ত্রিক অংশীদারিত্ব ও জায়গা-জমির মালিকানাপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু কোনোটাই হয়নি, যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সরকার বলছে চুক্তির মোট ৭৮টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু কার্যত ২৫টি ধারার বেশি বাস্তবায়িত হয়নি। তাও গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক কোন ধারা নয়। জনসংহতি নেতা বলেন, পার্বত্য মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদসমূহকে ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃংখলা, স্থানীয় পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং বন ও পরিবেশসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন যুগোপযুগীভাবে সংশোধন করা হলেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের এখনো কোনও বিধিমালা না হওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় জনবল ও অর্থ বরাদ্দ না হওয়ায় কার্যক্রমই চলছে না । ঊষাতন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সরকারের সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছে। এই সরকারকেই আমরা বলছি, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে সরকারের নীতি পুনর্বিবেচনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিভাজন করে নয়, সবাইকে আস্থায় এনে গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এবং জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠা বা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীনতার গুজবে কান না দিয়ে পার্বত্য সমস্যার সমাধান করতে হবে।ঊষাতন তালুকদার বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর গণতান্ত্রিক ধারায় আমরা অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করি, স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানাই। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন এনে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবনে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। এদের জমি দেয়া হয় স্থানীয় নিয়ম নীতি ভঙ্গ করে, জমি কবুলিয়ত দেয়া হয়, যার কারণে অনেক পার্বত্যবাসীর বন্দোবস্তকৃত ও দখলীকৃত জমিও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রচন্ড ক্ষোভ তৈরি হয় স্থানীয়দের মধ্যে। ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ গিয়ে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আমাদের বিকল্প ছিল না । এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংঘাতে জনসংহতির পাঁচশোরও বেশি কর্মী প্রাণ হারিয়েছে, সাধারণ মানুষ মারা গেছে ১৫ হাজারের মতো।


ষাটের দশকে ফিরে গিয়ে ঊষাতন তালকুদার বলেন, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান ১৯৬০ সালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অংশ হিসেবে কাপ্তাই বাঁধ দেওয়ার পর রাঙামাটির পার্বত্য ভূমির ৫৪ হাজার একর ধান উৎপাদনের জমি জলমগ্ন হয়ে যায় । সরকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করায় ক্ষতিগ্রস্তরা ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে, পরে তাদের অরুণাচল রাজ্যে নিয়ে যাওয়া নয়। ওই সময়ে তাদের সংখ্যা ছিল ৬০ হাজারের মতো । নিশ্চয়ই এখন সংখ্যা বেড়েছে । পরবর্তী সময়ে সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ১৯৮৬ সালে আরও ৬৭ হাজার আদিবাসী পার্বত্য ভূমি ছেড়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নেয় ।

১৯৯৫-১৯৯৬ সালের দিকে তাদের ভারত থেকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়, ১৯৮৭ সালে পার্বত্য চুক্তি সই হওয়ার পর তাদের ফিরিয়ে আনা হয় । কিন্তু তাদের অধিকাংশ এখনো পুনর্বাসিত হতে পারেনি । খাস জমি অথবা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে তাদের বসবাস করতে হচ্ছে ।সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসা ও অন্যান্য গোষ্ঠীর তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ঊষাতন তালুকদার বলেন, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা) নামে দু’টি গোষ্ঠী কাজ করছে। সংঘাত বাড়ছে, সম্প্রতি অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। জনসংহতি (লারমা) নেতা নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাসহ বেশকিছু নেতাকর্মী নিহত হয়েছে, আহতও অনেক। তবে ঊষাতন তালুকদার অভিযোগ করেন, এই দুই গোষ্ঠীর প্রতিই সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে, অভিযোগ জনসংহতি নেতার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *