BRAKING NEWS

প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাসের জিন সনাক্ত, টিকা আবিষ্কারের পথ খুলে গেল

বাসুদেব ধর (ঢাকা), ৩ ফেব্রুয়ারি (হি.স.) বাদুড় যে নিপাহ ভাইরাসের বাহক, শুধু সেটুকুই জানা ছিল। এবার তাকে পুরোপুরি চেনার পথ তৈরি হল । জ্বর, মাথা ধরা, পেশির যন্ত্রণা, বমি বমি ভাব থেকে শুরু করে ফুসফুসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর জন্য দায়ী যে ভাইরাস, সেই বাদুড় থেকে নিপাহ ভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচন করেছেন বিজ্ঞানীরা। শুধু তা-ই নয়, গবেষণাটির মাধ্যমে এ দেশের পরিবেশে নিপাহ ভাইরাসের বাহক বাদুড়ের বিস্তার, চলাচল ও সক্রিয়তা কেমন, তা-ও জানা গেছে। বিজ্ঞানীদের আশা, বাদুড়ে জীবাণুটির জিনগত বৈচিত্র্য শনাক্তের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো যাবে। সম্ভব হবে এ রোগের টিকা আবিষ্কারও। নিপাহ ভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচন (আইসোলেশন অ্যান্ড ফুল জিনোম ক্যারেক্টারাইজেইশন) সম্পর্কিত গবেষণা নিবন্ধ গত ১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী এমারজিং ইনফেকশাস ডিজিজ-এ ছাপা হয়েছে।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিকভাবে যে সব প্রাণঘাতী সংক্রামক ব্যাধিকে অগ্রাধিকার দেয়, নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ সেসব রোগের একটি। এ রোগের এখনো কোনও টিকা আবিষ্কার হয়নি। এই ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশই মারা যায়। মানুষ থেকে মানুষেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। ২০০১ সালে বাংলাদেশে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। প্রায় প্রতিবছরই এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ বছরে দেশে ৩০৩ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। এদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই মারা গেছে। গত বছরও আক্রান্ত তিনজনের মধ্যে একজন মারা গেছে। এ রোগে আক্রান্ত বেঁচে থাকা রোগীরা দীর্ঘ মেয়াদে নানা ধরনের স্নায়ুগত জটিলতায় ভুগে থাকে।প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। গত বছরের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার পশ্চিমে কেরালা রাজ্যে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়। কেরালায় আক্রান্ত ১৯ জনের মধ্যে ১৭ জনই মারা গেছে।            


বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচনের গবেষণাটি করেছেন সিঙ্গাপুর মেডিকেল স্কুল, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ইকোহেলথ অ্যালায়েন্স, অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী স্বাস্থ্য গবেষণাগার, বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি, কানাডার গুয়েলফ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও বাল্টিমোরের জন হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের ১৫ জন বিজ্ঞানী। গবেষকেরা বলেছেন, বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলে নিপাহ ভাইরাসের বাহক মূলত একই প্রজাতির বাদুড়। এত দিন বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড়ের রক্তরস অথবা জিনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার (পলিমারেজ চেইন রি-অ্যাকশন) মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস বা এই ভাইরাসের সংক্রমণকে চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু বাদুড় থেকে জীবিত নিপাহ ভাইরাসকে জিনগত মানচিত্রের মাধ্যমে আলাদা করা সম্ভব হয়নি। কেবল মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ায় দুটি সাফল্য পাওয়া গেছে। ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ার ‘সুঙ্গাইয়র নিপাহ’ গ্রামে প্রথম নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এই গ্রামের নামেই ভাইরাসটির নামকরণ। সে বছর দেশটিতে আক্রান্ত প্রায় ৩০০ জনের মধ্যে ১০০ জনের বেশি মারা গিয়েছিল। সেখানে বাদুড় থেকে শূকরে এবং শূকর থেকে মানুষের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়ায়।এ অঞ্চলে নিপাহ ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল ও বৈশিষ্ট্য শনাক্তের মাধ্যমে এ রোগের টিকা আবিষ্কারের সম্ভাবনাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে দেখছেন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী। তিনি বলেন, বাদুড় খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার সময় নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়। সেই রস পান করলে মানুষও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। একইভাবে বাদুড়ে খাওয়া কাঁচা পেয়ারা, কুল বা অন্য ফল থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। তাই খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে খাওয়া এবং এমন ফল না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।


এবার বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশে টেরোপাস মেডিআস গোত্রের বাদুড় থেকে নিপাহ ভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচন করলেন। জিনোম হলো জীবের জিনগত বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। বংশগতির সব বৈশিষ্ট্যই এক বা একাধিক জিনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব বৈশিষ্ট্যের তথ্য জানার প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো জিন নকশা উন্মোচন। এ থেকে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণের কৌশল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। আকারে বেশ বড় এই বাদুড় ফলখেকো বা উড়ন্ত শিয়াল নামে পরিচিত। ভারতীয় উপমহাদেশসহ অস্ট্রেলিয়া, পূর্ব আফ্রিকা, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এদের বসবাস। গবেষক দলে যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) তিন বিজ্ঞানী আশরাফুল ইসলাম, এম জেড রহমান ও ই এস গার্লি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *