স্বপ্নের ডুয়ার্স

  • অপর্না সাহা

অফিস এর কাজের চাপটা যেন দিন দিন বাড়ছে অমিতের। আর বাড়ি বসে থেকে আমার ও একঘেয়েমি লাগছে। অনেকদিন থেকে তাই ভাবছিলাম দূরে কোথাও একটু ঘুরে আসি, বেশ দূরে, নির্জনে। এমনটা যখন ভাবছিলাম তখন হঠাৎ একদিন পরিচিত একজন যে কিনা এক নামকরা ট্র্যাভেল এজেন্সির কর্ণ ধার, অলোক কাকার সাথে অমিত এর দেখা। বিয়ের পর আমরা দুজন সেভাবে কোথাও ঘুরতে যাইনি। তাই অলোক কাকার পরবর্তী ট্যুর ডুয়ার্স এ আমাদের যাওয়ার প্রস্তাব দিল। অনেকদিনের ইচ্ছেটা যে এভাবে পূরণ করার সুযোগ পাব সেটা আমরা সত্যি ভাবতে পারিনি।

১৪ই ফেব্রুইয়ারি,২০১৭ নবদ্বীপ ধাম থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হল। নবদ্বীপ থেকে তিস্তা-তোর্সা ট্রেন এ উঠলাম। তিস্তা-তোর্সা হল শিয়ালদহ থেকে আলিপুরদুয়ারগামী ট্রেন। অলোক কাকু টিকেট কেটে সব ব্যাবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছিল। ট্রেন এ ওঠার পর যে যার স্থানে বসলাম। অন্য পরিবার, যারা আমাদের সাথে ডুয়ার্স যাচ্ছিল তাদের সাথে আলাপ করে ভীষণ ভাল লাগলো। সবাই খুব মিশুকে আর উৎসাহী প্রকৃতির। বুঝতে পারলাম ভ্রমন টা বেশ উপভোগ্য হবে। রিশি, বুলি, তুলি, অর্ক আর বড়দের সবার সাথে পরিচয় হল। ওদের সাথে গল্প আড্ডায় কখন যে ট্রেন থেকে নামার সময় হয়ে এল টেরই পাইনি।

প্রথমে আমরা কুচবিহার এ নামলাম। আগে থেকে বুকিং করা হোটেল এ পৌঁছে সবাই একটু বিশ্রাম নিলাম। সকাল ৬ টায় চা দেয়া হল যার যার ঘরে। তারপর স্নান সেরে, ব্রেকফাস্ট করে অলোক কাকার সাথে দেখা করলাম আর জেনে নিলাম সারাদিনের বেড়ানোর পরিকল্পনা। মদন-মোহন মন্দির, রাজবাড়ী, তিস্তা নদী এই তিনটি তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা আমরা আজ যাব।

মদন-মোহন মন্দির, কুচবিহারের অন্যতম প্রাচীন মন্দির। অপূর্ব সুন্দর শুভ্র এই মন্দির প্রাঙ্গনে যে কত রকম বাহারি ফুলের সমাবেশ তার ইয়ত্তা নেই। ফুলের সৌরভ ও সৌন্দর্য এই কৃষ্ণ মন্দিরটিকে যেন বৃন্দাবন এ রূপ দিয়েছে। বহু ভক্ত আর অনুগামীদের আনাগোনা এই মন্দিরে। মন্দির প্রাঙ্গণে ঘুরতে ঘুরতে অনুধাবন করলাম- বদ্ধ চার দেয়ালের মাঝে থেকে যে ভালবাসায় আমি র আমিত এতদিন আবদ্ধ ছিলাম, এই খোলা পুণ্যভূমিতে সে বন্ধন যেন আর ও দৃঢ় বলে মনে হল।

কুচবিহারের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল ‘রাজবাড়ী’। গনতন্ত্র স্থাপিত হওয়ার বহু পূর্বে যে দেশে রাজা-রানির শাসনামল ছিল তা আমরা প্রায়শই ভুলতে বসেছি। পশ্চিমা আঙ্গিকে ইট দ্বারা তৈরি এ রাজপ্রাসাদ মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ১৮৮৭ সালে নির্মাণ করেছিলেন। প্রায় ৫১,৩০৯ বর্গফুট জায়গার উপর বিস্তৃত এই দ্বিতল প্রাসাদ। যার দৈর্ঘ্য ৩৯৫ ফুট ও প্রস্থ ২৯৬ ফুট। কুচবিহারের এই রাজপ্রাসাদ টি ‘ভিক্টর জুবিলি প্যালেস’ নামেও পরিচিত। কিছুটা বাকিংহাম প্যালেসের আদলে নির্মিত। প্রতিটি ফটকে নির্মাণ শৈলীর নিপুণতার পরিচয় মেলে। রাজবাড়ী আর তার সামনের লন ঘুরে দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়।

কাল সারাদিন রাত ট্রেন এ থাকার ক্লান্তিটা এবার বেশ অনুভব করছি। এদিকে খিদেয় পেট চো চো করছে। একটা ভাল রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে বিকেলে গেলাম তিস্তা নদীর পাড়ে। খোলা হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিলাম। নদীর দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য মনে হল নদী যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায় আর বলছে মনের যত সুপ্ত দুঃখ, কষ্ট, ক্লান্তি সব আমায় দিয়ে যাও, অবগাহন কর আমাতে; হও পরিতৃপ্ত। তখন শীতকাল তাই নদীর জল প্রায় শুকিয়ে গেছে। বর্ষায় নদীর ভরাট সৌন্দর্য দেখার ইচ্ছেটা আপাতত মনেই পুষে রাখলাম। পশ্চিম আকাশের রক্তিম সূর্যটা তখন অস্ত যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। সব মিলিয়ে এক অকৃত্রিম আবেশে মন টা ছেয়ে গেল।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থল হল ‘জয়ন্তী ফরেস্ট এবং পাহার’। আলিপুরদুয়ার জেলার অন্তর্গত ‘বক্সা টাইগার রিজার্ভ’ এর মধ্যকার জঙ্গলে ঘেরা জয়ন্তী নদী সংলগ্ন এক গ্রাম। জয়ন্তী নদী ও ভূটান এর পাহাড়ের মেলবন্ধনে তৈরি হয়েছে এক প্রাকৃতিক সীমানা। কি যে অপূর্ব সেই দৃশ্য বলে বোঝানো কঠিন। আমাদের সাথে একজন গাইড ছিল। বনদপ্তর থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে আমাদের সাথে। সে আমাদের মহাকালের মন্দিরের কথা বলল। মহাকালের মন্দিরের নাম আমরা আগেই শুনেছি। এখানকার মানুষেরা এই মন্দিরে ভগবান শিবের উপাসনা করে। পাহাড় বেয়ে বেশ খানিকটা উঠতে হবে সেই মহাকাল দেখতে চাইলে। তবে দেখতে না চাওয়ার কোন কারণই নেই। কারণ আমার আর রিশির মত অ্যাডভেঞ্চার এর নেশা সবার চেপে বসেছে। যা হোক সব মিলিয়ে আমাদের সতেরো জনের দল টা নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে চলেছি। একটু যেতেই মহাকালের মন্দিরের সন্ধান পেলাম। এই জায়গাটা একটু সমতল। ডান পাশে পাহাড় ঘেঁষে একটা উঁচু ঢিবির উপর স্থাপিত শিব লিঙ্গ আর ত্রিশূল। শিব দর্শন শেষে আর একটু গভীরে হেঁটে যেতেই নজর কাড়ল মনোরম এক পাহাড়ি ঝর্ণা। যার শব্দ আর সচ্ছতা দুটোই মন মাতানো।

এরপর আমরা দেখলাম ‘রাজা ভাত খাওয়া জাদুঘর’। বহু ইতিহাস এর সাক্ষ্য বহন করছে এই স্থানটি। তৎকালীন রাজা দীর্ঘদিন ভূটানে বন্দী থাকার পর যখন মুক্তি পেলেন তখন প্রথম এই স্থানে ভাত খেয়েছিলেন বলে এমন নামকরন করা হয়েছে। বহু পশু-পাখি, জন্তু দের নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এই জাদুঘরে। জাদুঘর দেখা শেষ করে লাটাগুড়ির দিকে রওনা হলাম। লাটাগুড়ি রিসোর্টে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। লাটাগুড়ির পথে আমাদের গাড়ি দুটো যখন ছুটছে তখন পথের দুধারে ঘন জঙ্গল সবার দৃষ্টি কাড়ল। অর্ক এতক্ষণ বেশ চুপচাপ বসে ছিল। হঠাৎ বেশ নড়েচড়ে বসল ময়ূর দেখার আশায়। চোখের পলক পর্যন্ত ফেলছে না পাছে কোন ময়ূর যদি না দেখতে পায়। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে চারপাশের গাছ-পালা গুলো দেখছিলাম। প্রতিটি গাছ যেন সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যুগযুগ ধরে। পরগাছা গুলো ও কম আকর্ষণীয় নয়। সবুজের কাছা কাছি আসার ব্যাকুলতা যেন একটু হলেও শান্ত হল। আমাকে আশাহত হতে হল না কারণ পথ মধ্যে দুটো ময়ূর দেখতে পেয়েছি।

আমাদের গাড়ি দুটো যখন রিসোর্টে পৌছালো তখন সন্ধ্যা। রিসোর্টের সামনে বিস্তৃত চা বাগান আর ঘন জঙ্গল আছে দেখে উৎফুল্ল হলাম। সামনের রাস্তায় দেখা হল তিনটি বাচ্চা ছেলের সাথে। কারোর বয়স ই ১০ এর বেশি নয়। ওরা কাল আমাদের ঐ জঙ্গল টা ঘুরে দেখাবে বলল। মনে মনে এই খুদে বীর দের বাহবা না দিয়ে পারলাম না। পরদিন সকালে আমরা মানে অভিভাবক বাদে বাকি সবাই তৈরি হয়ে নিলাম জঙ্গল পরিভ্রমনের জন্য। রিশি আর মিষ্টি দির বাবা, গৌরব কাকার উৎসাহের অন্ত নেই দেখে ওনাকেও আমাদের সাথে নিয়ে চললাম অভিভাবক হিসেবে। গভীর জঙ্গলের ভিতর সরু পায়ে হাঁটা পথ। আমরা চলছি ধীর পায়ে। একটু যেতেই দেখলাম অনেক ময়ূর। কোনটা গাছে বসে আছে তো কোনটা আবার পেখম মেলে নাচছে। সে যেন এক অদ্ভুত নৈসর্গিক দৃশ্য। খুদে গাইডরা আবার ময়ূর এর মত ডাকতেও জানে। ওদের ডাকে সাড়া দিচ্ছে ময়ূরগুলো।

বন আরও গভীর হল। বেশ একটা শিহরণ খেলা করছে শরীরে। হঠাৎ বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। টাটকা পায়ের ছাপ যেন মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই হেঁটে গেছে এই পথে। মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমাদের গাইড করা বাচ্চাগুলোকে এবার ভীত সন্ত্রস্ত লাগলো। কারণ ওরা আচমকাই দাঁড়িয়ে পড়েছে। সামনেই কোন বাঘের অস্তিত্ব আছে বুঝতে পেরে আমাদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিল। দূর থেকে যেন একটা চাপা গর্জন কানে এলো। আর এক মুহূর্ত নয়। তখনি রিসোর্টে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। হঠাৎ বুঝলাম পথ চিনতে পারছিনা। দুটো সরু রাস্তার ঠিক কোনটা দিয়ে এসেছিলাম মনে পড়ছে না। তুলির মন পড়ল পথ টা। আমরা তাড়াতাড়ি সেদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বাঘ দেখার আশা যে বাঘের গর্জনে পূর্ণ হবে সত্যি ভাবিনি। এ প্রাপ্তি বা কম কিসে?

পরদিন সকালে অলোক কাকা আমাদের জানিয়ে দিল যে স্যামসিং চা বাগান, ঝুলন্ত সেতু এবং রকিং আইল্যান্ড দেখে আমাদের ভ্রমনের সমাপ্তি হবে এবারকার মত। স্যামসিং চা বাগানে চা গাছ গুলোকে দেখলে মনে হয় কোন এক শিল্পী যেন আপন হাতের ছোঁয়ায় সযত্নে রোপণ করেছে। দূর থেকে দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। শিল্পী ই বটে এখানকার মানুষেরা। এরা মূলত চাষাবাদ করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের পরিশ্রম আর শৈল্পিক মন প্রকৃতিকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করেছে। পাহাড় আর বন যেন মিলে মিশে এক হয়েছে এখানে। এলাকার স্থানীয় উপজাতিরা ফুল খুব ভালবাসে আর সেটা বুঝতে পারি প্রত্যেকের বাড়ির সামনে রাখা বাহারি রকমের ফুল গাছ দেখে। কি চমৎকার সেই ফুলের রং; চোখ ধাধান-মন মাতানো। একটু এগোতেই আরও লোকজন দেখলাম যারা আমাদের মত ‘ঝুলন্ত সেতু’ দেখতে এসেছে। সেতু দেখা শেষে গেলাম ৫ কিঃমিঃ দূরেই ‘রকিং আইল্যান্ড’এ। অপূর্ব, মনোরম এই আইল্যান্ড। অনেক বড় বড় পাথর আর তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে জলধারা। যে জলের উৎস হয়তো কোন পাহাড়ি ঝর্ণা। সব মিলিয়ে যেন এক সুন্দর দ্বীপ। ক্যামেরা বন্দী করে রাখার মতন এমন মনোরম দৃশ্য সহসা মেলা ভার। এদিকে রিসোর্টে ফেরার সময় হয়ে গেছে। এখানেই কিন্তু শেষ নয়। একে তো নির্জন জায়গা তার উপর রিশির রোমহর্ষক ভুতের গল্প না শুনে ঘুমোতে যেতে ইচ্ছে করেনা।

দেখতে দেখতে ফেরার দিনটা চলে এলো। মালবাজার হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেন ধরলাম। এবারকার মত যাত্রা হয়তো আমাদের শেষ হল। কিন্তু ভ্রমনের ক্ষুধা বেড়ে গেল। শহরের যান্ত্রিক জীবনের কোলাহল থেকে কয়েকটা দিন প্রকৃতির কাছে থাকার সুবর্ণ সুযোগ আবার কবে পাব জানি না। তবে মনোরম এই ভ্রমন স্মৃতি আজীবন মনে গেঁথে থাকবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস। ভ্রমন সঙ্গীদের ছেড়ে যে যার গন্তব্যে ফিরে যাব। আবার কাজে ব্যস্ত হবে সবাই। কিন্তু বন্ধুত্বের অঙ্গীকার বদ্ধ হলাম আমরা সবাই। যখন বাড়ি ফিরছি তখন মধ্যরাত। কিছুক্ষন বাদে সকাল হবে। সময়ের চাকা কখনও থেমে থাকেনা। আমাকেও তার সাথে এগোতে হবে। আর এই চলার পথে সঙ্গী হবে আমার এই ভ্রমন অভিজ্ঞতা, যার ভাণ্ডার এই দুর্লভ মানব জীবনকে অর্থবহ করে তুলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *