মমতা-চন্দ্রবাবু বৈঠক, কটাক্ষ বিরোধীদের

কলকাতা, ১৯ নভেম্বর (হি.স.) : গণতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতায় একজোট হওয়ার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করলেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু। সোমবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনার পর চন্দ্রবাবু সাংবাদিকদের কাছে এই কথা বলেন। আর সোমবার এই বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে কটাক্ষ করতে ছাড়েন নি পশ্চিমবঙ্গের শাসক বিরোধী নেতারা।
চন্দ্রবাবু নাইডুর আজকের বৈঠককে ‘মেরুকরণ’ বলে মন্তব্য করেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। সূর্যবাবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করেন, ‘আপনাকে কি লুকোতে হচ্ছে? এত ভয় কিসের? সিবিআই-কে আটকাতে পারেন না। এটা সংবিধান বিরুদ্ধ’।
একধাপ এগিয়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সাধারন সম্পাদক রাহুল সিনহা বলেন, ‘চন্দ্রবাবু নাইডুর রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজনও ভোটার নেই৷ আর এরাজ্যও চন্দ্রবাবু নাইডুর একজনও ভোটার নেই৷ তবে এই জোটের কোনও মানে নেই৷ এই বৈঠকেরও কোনো মানেই হয় না’৷
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক সফল বলে মন্তব্য করে চন্দ্রবাবু নাইডু সাংবাদিকদের বলেন, দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন। সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। রাজনীতিকদের সিবিআই ভয় দেখাতে শুরু করেছে। মুদ্রাব্যবস্থা একটা বড় প্রশ্নের মুখে। টাকার দাম পড়ছে, পেট্রোপন্যের দাম উঠছে। আগামী ২২ নভেম্বরের প্রস্তাবিত বৈঠক বাতিল হওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করলে চন্দ্রবাবু বলেন, লোকসভা ভোটের প্রচার শুরুর আগে বিরোধী নানা দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক হবে। শীতকালীন অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই একটা ঐক্যমত্যে পৌঁছোনোর চেষ্টা হবে।
এছাড়া আগামী ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেড প্যারেডে মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবিত সমাবেশ নিয়ে চন্দ্রবাবু এ দিন সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য না করলেও মমতা নিজে চন্দ্রবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘উনি এখানে এসে আলোচনা করেছেন বলে আমরা কৃতজ্ঞ। প্রায় সব বিরোধী দলই ওই সমাবেশে অংশ নেবে। বিজেপি সরকারর বিরুদ্ধে লড়াই চলবে’।
সোমবার মমতা- চন্দ্রবাবু বৈঠক শেষ হওয়ার পরই রাহুল সিনহা বলেন, ‘বাকি যে সব দল নিয়ে বিজেপি বিরোধী যত গঠনের কথা হচ্ছে, যার যা রাজ্যে সে সে শক্তিশালী৷ সারা ভারতে তাদের কিছুই নেই ৷ তাই এই জোটের কোনো মানেই নেই৷ চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে এখানে মমতা যত করলে কি হবে, একটা ভোট হবে৷ শুধু তাই নয়, অন্য রাজ্যে যারা আছে তাদেরও কিছু নেই ৷ নিজের রাজ্য ছাড়া অন্য রাজ্যে ভোট নেই’৷ রাহুল সিনহার মতে, ‘মানুষ এটা বুঝে গেছে এটা চোরেদের জোট৷ সিবিআইয়ের হাত থেকে বাঁচার জোট৷ আর ভারতবর্ষের যে চৌকিদার নরেন্দ্র মোদী, তাঁর বিরুদ্ধে জোট৷ অতএব মানুষ এটা বুঝে গেছে চৌকিদারের সঙ্গে থাকতে হবে৷ আর এই চোরেদের জোটকে ছুড়ে দিতে হবে৷ ভারতবর্ষ দেশে কয়েকটা জগা খিচুড়ি সরকার দেখেছে৷ তার বিষময় ফলও মানুষ দেখতে পেয়েছে৷ সেই কারনে আর মানুষের জগা খিচুড়ির মধ্যে যাবার বাসনা নেই ৷ অতএব ঘুরে ফিরে দেশের জে চৌকিদার, যার হাতে দেশ সুরক্ষিত সেই রকম মানুষ নরেন্দ্র মোদীর ওপরে লোকে আস্থা রাখছে’৷
লোকসভা ভোটের আগে বিরোধী জোটের একত্রিত হয়ে প্রথম বৈঠক হওয়ার কথা ছিল ২২ নভেম্বর৷ সোমবার আকস্মিক ভাবেই সেই বৈঠক পিছিয়ে গেল৷ সূত্রের খবর, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করেই বৈঠকের পরবর্তী দিন স্থির করছেন তেলুগু দেশম পার্টি সুপ্রিমো চন্দ্রবাবু নায়ডু৷ জানা গেছে, দিল্লিতে বৈঠক হতে পারে আগামী ১০ ডিসেম্বর৷
এদিন ৩টে ৩০ নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছান চন্দ্রবাবু নাইড়ু। পৌনে চারটে নাগাদ তিনি কলকাতায় এসে পৌঁছান। নবান্নের গেটে তাকে স্বাগত জানান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাড়ে চারটেতে নবান্নে শুরু হয় বৈঠক।লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি বিরোধী জোট পোক্ত করতেই এই বৈঠক বলে রাজনৈতিক মহলের ধারনা। বিজেপি বিরোধী জোটের ক্ষেত্র তৈরি করতে দু’জনেই এককাট্টা। দু’জনেই চান নরেন্দ্র মোদী জমানার অবসান।
চলতি বছরেই বেঙ্গালুরুতে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গিয়েছিলেন চন্দ্রবাবু ‌সহ বিরোধী নেতারা। সেখানেই চন্দ্রবাবু বলেছিলেন, ‘‌মমতাজি সব আঞ্চলিক দলকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে চাইছেন। তিনি চান, সকলে মিলে ২০১৯-এর নির্বাচনে বিজেপি‌র বিরুদ্ধে লড়াই করি। মমতাজির এই উদ্যোগ আমি সমর্থন করি। আমরা একসঙ্গে কাজ করব’।
তারপরে চন্দ্রবাবু মমতার সঙ্গে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা বলেছেন। বিরোধীদের জোট তৈরি করতে মমতার পরামর্শ অনুযায়ী চন্দ্রবাবু ময়দানে নেমে পড়েছেন। ইতিমধ্যেই তিনি রাহুল গান্ধী ‌সহ বিরোধী নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। জোটে কংগ্রেস,‌ সিপিএম,বহুজন সমাজ পার্টির ওই জোটে যোগদান নিয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। এর মধ্যেই পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন শুরু হয়েছে। যার ফল প্রকাশিত হবে ১১ ডিসেম্বর। সেই ফলাফলের ওপর বিরোধী জোটের গতি অনেকটাই নির্ভর করবে। যদি হিন্দি বলয়ের তিনটি রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ে বিজেপি ধরাশায়ী হলে সমীকরণ যেমন বদলাবে, তেমনই দাক্ষিণাত্যের তেলেঙ্গানায় বিজেপি ভাল ফল না করলে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন চন্দ্রবাবু নিজে।
তৃণমূল নেত্রী প্রথম থেকেই আগামী লোকসভা ভোটে বিজেপির বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াইয়ের প্রস্তাব দেন। সে বিষয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী, সনিয়া গান্ধী সহ তেলাঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও, এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ার সহ একাধিক নেতার সঙ্গে দেখা করেন। এর পাশাপাশি ফেডেরাল ফ্রন্ট গঠনের জন্য দিল্লিতেও বেশ কয়েকবার বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। জুলাইয়ে কলকাতায় আসেন জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। এবার বিরোধী জোট জোরদার করতে নবান্নে আসছেন তেলাঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু। অন্যদিকে ১৯ জানুয়ারি বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে ব্রিগেডে সভা করবে তৃণমূল।
ইতিমধ্যেই কুমারস্বামী, স্ট্যালিন, অখিলেশ যাদব ও মায়াবতীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন চন্দ্রবাবু নাইডু। মমতা অবশ্য ভোটের ফলাফল নির্বিশেষেই বিজেপির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই চালিয়ে যাবেন। সেই লড়াইয়ে তিনি চন্দ্রবাবুকেও পাশে পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সরাসরি অধীনস্থ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে অন্ধ্রপ্রদেশে কার্যত নিষিদ্ধ করেছেন চন্দ্রবাবু। একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতাও। বস্তুত, চন্দ্রবাবুর আগে থেকেই মমতা সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শুরু করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘সিবিআই ‌সহ অন্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি ভয় দেখাচ্ছে। কেন্দ্রের সরাসরি নির্দেশে কাজ করছে।’ সেই সূত্রেই চন্দ্রবাবুর মতোই মমতার সরকারও নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দিয়েছে, বাংলায় সিবিআই পা দেওয়ার আগে রাজ্য সরকারের আগাম অনুমতি নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *