গেরুয়া সুনামীতে তছনছ লাল সাম্রাজ্য

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৩ মার্চ৷৷ গেরুয়া সুনামিতে রাজ্যে লাল সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে গেল৷ নির্বাচনে লড়াই সেয়ানে সেয়ানে হলেও বিজেপির

শনিবার উমাকান্ত একাডেমিতে ভোট গণনা চলাকালে বিজেপির বনমালীপুর কেন্দ্রের প্রার্থী তথা দলের রাজ্য সভাপতি বিপ্লব কুমার দেব সমর্থকদের মাঝে৷ ছবি নিজস্ব৷

একাধিপত্য কায়েম হয়েছে৷ বিজেপি একাই ৩৫টি আসন দখল করেছে৷ আইপিএফটিও ৮টি আসন দখল করতে পেরেছে৷ অন্যদিকে, বাম শিবিরে কেবল সিপিএম আসন দখল করতে পেরেছে৷ বামফ্রন্টের ৬০ আসনে একা সিপিএম ১৬টি আসন ধরে রাখতে পেরেছে৷ বাকি তিন শরিক দল ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে৷ শুধু তাই নয়, গেরুয়া ঝড়ে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং আইএনপিটি নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে৷ এই প্রথম ত্রিপুরা বিধানসভা কংগ্রেস শূণ্য হয়েছে৷

নির্বাচনে ভোট শতাংশের হিসেবে বিজেপির সাথে সিপিএমের খুব একটা ফারাক নেই৷ শতাংশের হিসেবে বিজেপি পেয়েছে ৪৩ শতাংশ ভোট এবং সিপিএম পেয়েছে ৪২.৭ শতাংশ ভোট৷ তাতে মোট ভোট গিয়ে দাঁড়ায় বিজেপি’র ৯৯৯০৯৩টি এবং সিপিএম’র ঝুলিতে পড়েছে ৯৯২৫৭৫টি ভোট৷ তাতে সিপিএমের সাথে বিজেপি’র জয়ের ব্যবধান মাত্র ৬৫১৮ ভোটের৷ শতাংশের হিসেবে এই ব্যবধান হল ০.৩ শতাংশ৷ কিন্তু, বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট শতাংশের হিসেবে ৪৪.৯ শতাংশ৷ সে জায়গায় বিজেপি-আইপিএফটি জোটের প্রাপ্ত ভোটের হার ৫০.৫ শতাংশ৷ সেক্ষেত্রে বামফ্রন্ট পেয়েছে মোট ১০ লক্ষ ৪২ হাজার ৬১০টি ভোট এবং বিজেপি-আইপিএফটি জোট পেয়েছে ১১ লক্ষ ৭২ হাজার ৬৯৬টি ভোট৷ ব্যবধান ১ লক্ষ ৩০ হাজার ৮৬ ভোটের৷

গত নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল ছিল কংগ্রেস৷ প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল ওই দল৷ আসন জিতেছিল ১০টি৷ কিন্তু, এবার কোন আসন জিততে পারেনি কংগ্রেস৷ বরং ভোটের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১.৮ শতাংশ৷ ৫৯টি আসনে কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ৪১ হাজার ৩২৫৷ তৃণমূল কংগ্রেস এবং আইএনপিটি’র আরো দৈন্যদশা৷ তৃণমূল কংগ্রেস মোট ভোট পেয়েছে ৬৯৮৯টি এবং আইএনপিটি পেয়েছে ১৬ হাজার ২৫৫টি ভোট৷ ফলে, কংগ্রেস এবং বাকি দলগুলিকে নিয়ে ভোট বিভাজনের যে আশঙ্কা করছিল বিজেপি, তা রাজ্যের ভোটাররা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন৷

এবারের নির্বাচনের বামেদের সবচেয়ে বড় বিপর্য্যয় হল, বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্য পরাজিত হয়েছেন৷ অঘোর দেববর্মা, মানিক দে, প্রয়াত খগেন্দ্র জমাতিয়া, মণিন্দ্র রিয়াং এবং নরেশ জমাতিয়া নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন৷ অল্পের জন্য আসন ধরে রাখতে পেরেছেন তপন চক্রবর্তী ও বিজিতা নাথ৷ তপন চক্রবর্তী ৪০২ ভোট এবং বিজিতা নাথ ২৭০ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷ বিজেপি প্রার্থীরা এই দুটি আসনে পুনঃগণনার আবেদন জানালেও, তাঁরা গণনা শেষে জয়ী হন৷ বিধানসভার মুখ্য সচেতক বাসুদেব মজুমদার হেরে গেছেন৷ বিলোনীয়া কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী হিসেবে তিনি বিজেপি প্রার্থী অরুন চন্দ্র ভৌমিকের কাছে মাত্র ৭৫৩ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন৷ দক্ষিণ জেলা অন্যতম বামদূর্গ হিসেবে পরিচিত বিলোনীয়া কেন্দ্রে বামেদের পরাজয় বিজেপির বিরাট সাফল্য বলেই ধরে নিচ্ছে রাজনৈতিক মহল৷ অধ্যক্ষ রমেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথও খুবই সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷ ২০১৩ বিধানসভা নির্বাচনে তিনি ২৮৭৮ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন৷ কিন্তু, এবার তিনি মাত্র ৬৪৯ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷ তবে, আসন ধরে রাখতে পারেননি উপাধ্যক্ষ পবিত্র কর৷ ৭০৩৯ ভোটের ব্যবধানে তিনি পরাজিত হয়েছেন৷ গত নির্বাচনে তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল ১২৯৭৷ এছাড়া মনু কেন্দ্রটি সিপিএম অল্পেতে ধরে রাখতে পেরেছে৷ ওই কেন্দ্রে সিপিআইএম প্রার্থী প্রভাত চৌধুরী মাত্র ১৭৩ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷

আজ গণনার দিন সিপিএম সবচেয়ে বেশি চিন্তায় ছিল মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে নিয়ে৷ ধনপুর কেন্দ্রে গণনায় তৃতীয় রাউন্ডে তাঁর জয়ের ব্যবধানর ৫০৭০ হলেও, ৩টি বুথে গণনা নিয়ে গোলযোগ দেখা দেয়৷ মূলত, ওই বুথগুলির ইভিএমের কাগজে বিজেপির কাউন্টিং এজেন্টের সই ছিল না৷ এই ইস্যুতে বিজেপি পুনঃনির্বাচনের দাবি জানায়৷ ফলে, গণনা শেষ হতে অনেক বিলম্ব হয়৷ একাধিকবার পুনঃগণনা শেষে নির্বাচন কমিশন মানিক সরকারকে ৫৪৪১ ভোটের ব্যবধানে জয়ী ঘোষণা দেয়৷

আরেকটি তাৎপর্য্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০১৩ বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী বিধায়করা এখন বিজেপিতে গিয়ে গতবারের তুলনায় অনেক বেশি ভোট ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷ বিজেপি রাজ্য সভাপতি বিপ্লব দেব বনমালীপুর আসনে ৯৫৪৯ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷ ২০১৩ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী গোপাল রায় ৫৭৬২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন৷ এছাড়াও সুদীপ রায়বর্মণের জয়ের ব্যবধান ২০১৩ বিধানসভা নির্বাচনে ছিল ২৭৬২৷ এবার তিনি ৭৩৮২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷ ধর্মনগর কেন্দ্রে বিশ্ববন্ধু সেন গত নির্বাচনে ১৮৪৪ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন৷ এবার তাঁর জয়ের ব্যবধান ৭২৮৭৷ বাধারঘাট কেন্দ্রে দিলীপ সরকার গত নির্বাচনে মাত্র ৬৪৩ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন৷ এবার তিনি ৫৪৪৮ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷ টাউন বড়দোয়ালী কেন্দ্রে আশীষ কুমার সাহা গত নির্বাচনে ৭০৬০ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন৷ এবার তাঁর জয়ের ব্যবধান বেড়ে হয়েছে ১১১৭৮৷ রাধাকিশোরপুর কেন্দ্রে প্রণজিৎ সিংহ রায় গত নির্বাচনে মাত্র ৮৭৩ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন৷ এবার তিনি ৪৮৪৬ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷ কংগ্রেসের টিকিটে ২০১৩ সালে রামনগর কেন্দ্রে সুরজিৎ দত্ত মাত্র ৬৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন৷ কিন্তু, এবার তিনি বিজেপির টিকিটে প্রার্থী হয়ে গতবারের বিজয়ী প্রার্থীকে ৪৮৫৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন৷ দীবাচন্দ্র রাঙ্খলেরও জয়ের ব্যবধান এবার অনেক বেড়েছে৷ করমছড়া কেন্দ্রে গত নির্বাচনে তাঁর ব্যবধান ছিল ১৩৭২৷ এবার তিনি ৭৩৩৬ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷ চমকপ্রদ ফলাফল হয়েছে রতন লাল নাথেরও৷ গত নির্বাচনে মোহনপুর কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ৭৭৫৷ এবার তিনি বিজেপির টিকিটে প্রার্থী হয়ে ওই কেন্দ্রেই ৫১৭৬ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷

এছাড়াও বিজেপি প্রার্থী রতন চক্রবর্তী, মনোজ কান্তি দেব, সুশান্ত চৌধুরী, কল্যাণী রায়, রেবতি মোহন দাস কংগ্রেস ও সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে ভাল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন৷

এই নির্বাচনে বামেদের মহিলা প্রার্থীদের মধ্যে কেবলমাত্র একজন জয়ী হয়েছেন৷ বিজিতা নাথ ছাড়া আর কেউ জয়ী হতে পারেননি৷ ঝর্ণা দাস বৈদ্য, কৃষ্ণা মজুমদার, রীতা কর মজুমদার, গৌরী দাস, টুনুবালা মালাকার এবং বিজয়লক্ষ্মী সিনহা পরাজিত হয়েছেন৷

এদিন, গণনা শুরু হতেই প্রথমে পোস্টাল ব্যালট বিজেপির হৃদকম্পন বাড়িয়ে দিয়েছিল৷ শুরুতে বেশ কিছু সময় সিপিএম এগিয়ে ছিল৷ কিন্তু, একটা সময়ে বিজেপি এমন গতি নেয়, তাতে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি৷ বিজেপির বিরাট সাফল্যে দিনভর সারা রাজ্যে উৎসবের মেজাজে কাটিয়েছেন দলীয় কর্মী সমর্থকরা৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *