BRAKING NEWS

শরণার্থীদের আশ্রয়ে মানবিক ইন্দিরা ও শচীন্দ্র লালদের মৈত্রী উদ্যানের উদ্বোধনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ মুখ্যমন্ত্রীর

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১৬ ডিসেম্বর৷৷ চোত্তাখোলায় ভারত- বাংলা মৈত্রী উদ্যানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াতা ইন্দিরা

চোত্তাখোলায় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যানের উদ্বোধন করা হয় শনিবার৷ ছবি নিজস্ব৷

গান্ধীর ভূয়সী প্রশংসা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ শুধু তাই নয়, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শচীন্দ্র লাল সিংহ এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও প্রশংসা করলেন তিনি৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে ত্রিপুরাতে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা যে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেই জন্যই এদিন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বিনম্রতার সাথে তাঁদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানান৷ পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার মৈত্রীর সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে সময় নষ্ট না করে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সে দেশের সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণে আশা প্রকাশ করেন তিনি৷
বিলোনিয়া মহকুমায় রাজনগর ব্লক এলাকার চোত্তাখোলায় ২০২০ হেক্টর জমির উপর নির্মিত হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান৷ এই উদ্যানটি রাজধানী আগরতলা থেকে ১২০ কিমি দুরে অবস্থিত৷ ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা, দীপু মনি এই মৈত্রী উদ্যানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন৷ এই উদ্যানে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি শহিদ মিনার গড়ে তোলা হয়েছে৷ ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের ভাস্কর্য মূর্তি শহিদ মিনারে দুই ধারে স্থাপন করা হয়েছে৷ এই উদ্যানে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল কয়েকটি বাঙ্কার, তার নিদর্শন রাখা হয়েছে৷ এখানে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কবর চিহ্ণিত করে নতুন করে কবর গড়ে তোলা হয়েছে৷ এই উদ্যানের দেওয়ালে উৎকীর্ণ রয়েছে ভারত-বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত৷ রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি স্ট্যাচু, ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জলাশয় ও তার উপর ঝুলন্ত সেতু৷ তবে, এই মৈত্রী উদ্যানে এখনো অনেক ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ বাকি রয়েছে৷ বিশেষ করে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত কামান সহ সমরাস্ত্র প্রদর্শনীর কাজ এখনো সমাপ্ত হয়নি এই উদ্যানে৷ এরজন্য নির্দিষ্ট জায়গায় চিহ্ণিত করে সেনাবাহিনীর জন্য রাখা হয়েছে৷
এদিন এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে মৈত্রীর যে বন্ধন এবং ত্রিপুরা-বাংলাদেশের মধ্যে যে আত্মিক বন্ধন রয়েছে তা আরো সুদৃঢ় করতে এই মৈত্রী উদ্যান নিঃসন্দেহে এক বড় ভূমিকা নেবে৷ বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে এদিন তিনি দু দেশের জনগনকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন৷ পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন৷
এদিন মুখ্যমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, পাক সেনাবাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিরিহ মানুষ ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে আশ্রয় নিতে শুরু করেছিলেন৷ তাঁদেরই একটা অংশ ত্রিপুরায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ তখন ১৬ লক্ষ শরনার্থি ত্রিপুরার বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ মুখ্যমন্ত্রী এদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াতা ইন্দিরা গান্ধী যে সাহসী ও কুটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা স্মরণ করেন৷ তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার মানবিকতার উচ্চ আদর্শের নিদর্শন স্থাপন করে বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য সীমান্তের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন৷ পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী বিশেষভাবে স্মরণ করেন তৎকালীন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শচীন্দ্র লাল সিংহ ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের কথা৷ তিনি বলেন, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা তখন কেন্দ্রীয় সরকারের উদারতার সাথে সাযুজ্য রেখে ত্রিপুরা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিতে ত্রিপুরায় এসেছিলেন৷ তাঁদের সাহায্যে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ অবশ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার মানুষের আবেগ, অনুভব, সহমর্মিতা এতটাই সম্পৃক্ত ছিল যে, তা সেই সময় ত্রিপুরাকে বাংলাদেশের মুক্তিকামি মানুষের পাশে দাঁড়াতে প্রভাবিত করেছিল৷ মুখ্যমন্ত্রী এদিন সেইসময় ত্রিপুরার জনগণ যে ভূমিকা নিয়েছিলেন তার প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন৷
এদিকে, বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যিক আদান-প্রদান ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে আরো উন্নতির আশা প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তিনি চাইছেন, বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্পের আদান-প্রদান বাড়তে থাকুক৷ পাশাপাশি তিনি আরো চাইছেন, স্থলপথ, বিমান, রেলপথ, জলপথ এবং টেলিযোগাযোগ সবকিছু মিলিয়ে উন্নত থেকে উন্নততর হউক৷ আধুনিক সমস্ত সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যাধুনিক হোক, চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তাই তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের সাথে এরাজ্যের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে৷
তিনি বলেন, সাব্রুমের উপর দিয়ে যে ফেণী নদী বয়ে গেছে তার একটা অংশ বাংলাদেশে গিয়ে পড়েছে৷ এই নদীর উপর নির্মিত হচ্ছে সেতু৷ এই সেতু থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের দূরত্ব ৭২ কিমি৷ সাথে তিনি যোগ করেন, ইতিমধ্যে উদয়পুর পর্যন্ত রেল পরিষেবা সম্প্রসারিত হয়েছে৷ সাব্রুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে৷ ফেণী নদীর উপর যে সেতু হচ্ছে তা থেকে সাব্রুম রেল স্টেশনের দূরত্ব হবে ৪-৫ কিলোমিটার৷ ফলে, যোগাযোগের এই ক্ষেত্রটা সম্প্রসারিত হয়ে গেলে বাংলাদেশ আমাদের আরো কাছে এসে যাবে৷ তাই মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, ভারতের সাথে কুটনৈতিক বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অস্পষ্টতা থাকলেও যোগাযোগের ক্ষেত্র সম্প্রসারণে সে দেশের সরকার উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিক৷ তাই মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি প্রদানে সময় নষ্ট করা ঠিক হবেনা৷ এই যোগাযোগের বিষয়টি ভারত-বাংলার অসম্পূর্ণ অন্যান্য বিষয়ের সাথে যুক্ত করে ফেলে রাখাও ঠিক হবেনা বলে মনে করেন তিনি৷ তাঁর বক্তব্য, তাতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভুল সংকেত যাবে৷ তাই মুখ্যমন্ত্রী এবিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দ্রুত কার্যকরে বাংলাদেশ সরকার সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন৷
এদিন এই অনুষ্ঠানের অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, পূর্তমন্ত্রী বাদল চৌধুরী, পর্যটন মন্ত্রী রতন ভৌমিক, বন মন্ত্রী নরেশ জমাতিয়া, সাংসদ শংকর প্রসাদ দত্ত, সাংসদ জীতেন্দ্র চৌধুরী, রাজ্য বিধানসভার মুখ্য সচেতক বাসুদেব মজুমদার, বিধায়ক সূধন দাস, দক্ষিণ জেলার জেলা শাসক সিকে জমাতিয়া, বন দপ্তরের পিসিসিএফ ডা, এ কে গুপ্তা, দক্ষিন ত্রিপুরা জেলা পরিষদের সভাধিপতি হিমাংশু রায়, বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, বাংলাদেশের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল এবং আগরতলাস্থিত বাংলাদেশ ডেপুটি হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার শেখাওয়াত হোসেন৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *