BRAKING NEWS

দীর্ঘ সংগ্রাম ও জাগরণ

তথ্য বিস্ফোরণের যুগ শুরু হইয়াছিল অনেক আগেই৷ মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমেও আসিয়াছিল যুগান্তকারী উন্নতি আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরিয়া৷ এই ব্যাপক প্রযুক্তির সন্নিবেশের মাঝে প্রশ্ণ উঠিতে পারে প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা কতখানি সুনিশ্চিত হইয়াছে৷ কতখানি স্বচ্ছতা, পরিশুদ্ধতায় প্রচার মাধ্যম সত্যিই কোনও দিন অগ্ণি পরীক্ষায় উত্তির্ণ হইতে পারিয়াছে কিনা৷ অভিজ্ঞতায় দেখা যাইতেছে, প্রচার মাধ্যম পঁূজির দলদাসে পরিণত হইয়াছে বা হইতেছে৷ বড় বড় কর্পোরেট হাউস ও পুঁজিপতিদের হাতে প্রচার মাধ্যম বন্দীদশায় উপনীত হইয়াছে৷ তাহারা আবার রাজনৈতিক শক্তির হইয়া ময়দানে অবতীর্ণ৷ গরীব সাধারণ মানুষের জন্য লড়াই করিবার ক্ষেত্রে প্রচার মাধ্যমের বিমুখতা বাড়িতেছে৷ পেইড নিউজের আগ্রাসন হইতে প্রচার মাধ্যমের মুক্তি ঘটিবে এমন সম্ভাবনাও দেখা যাইতেছে না৷ জৌলুস, জেল্লা, মুদ্রণের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক মেশিনের ব্যবহার এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ব্যাপক প্রসার সত্বেও মানুষের গভীর প্রত্যাশার বাস্তবায়ন কতখানি সম্ভব হইয়াছে তাহাও কঠিন প্রশ্ণের মুখে দাঁড়াইয়া আছে৷ যখন সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের প্রাণ হুমকির মুখে, নিশ্চিত নিরাপত্তা নাই বলিলেই চলে, এই রকম এক সন্ধিক্ষণে ত্রিপুরার প্রথম দৈনিক ‘জাগরণ’ চৌষট্টিতম বছরে পদার্পণ করিল৷ ১৯৫৪ সালে দোসরা অক্টোবর, অহিংসার পুজারী জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে ত্রিপুরায় প্রথম আত্মপ্রকাশ করিয়া সেদিন দুঃসাহসিক ইতিহাসের জন্ম দিয়াছিল বলা যাইতে পারে৷ দেশ বিভাগের কারণে লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা এই ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়াছিল৷ তাহাদের দুঃখ যন্ত্রণা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হইয়া সেদিন, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে অগ্ণিক্ষরা ভূমিকা রাখিয়া জাগরণ যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে ব্রতী হইয়াছিল, তাহা আজকের এই তথ্য বিস্ফোরণের যুগে রীতিমতো ভাবনার বিষয় বলা যাইতে পারে৷ ত্রিপুরার প্রথম দৈনিক ‘জাগরণ’ কঠিন লড়াই করিতে গিয়া বিধবস্ত হইবার ইতিহাসও আছে৷ ১৯৮৩ সালে পত্রিকা প্রকাশনা চালাইয়া রাখা অনিশ্চিত হইয়া পড়িয়াছিল আর্থিক সংকটের কারণে৷ সেই সময়েই এই প্রাচীন দৈনিকের প্রকাশনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলিয়া নেন আজকের সম্পাদক৷ শুরু হয় আরেক কঠিন সংগ্রাম৷ রাজ্য সরকারের ঘোষিত বিজ্ঞাপন নীতি না মানার বিরুদ্ধে জাগরণ প্রেস কাউন্সিলের দ্বারস্থ হয়৷ মামলায় জয়ী হইয়া প্রচীন এই দৈনিক নতুন আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছিল৷
১৯৮৮ সালে জাগরণ সম্পাদককে প্রাণে মারিবার ষড়যন্ত্রও ব্যর্থ হয়৷ তখন দুর্বৃত্তরা এই পত্রিকা অফিসে হামলা চালায়৷ প্রেস ভাঙচুর করে৷ আজ সাংবাদিক তথা সিপিআই(এম) এর যুব সংগঠনের একনিষ্ট কর্মী শান্তনু ভৌমিক খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠিয়াছে৷ সেদিনও, ১৯৮৮ সালে বাম দূর্গ ত্রিপুরায় জাগরণ সম্পাদক অল্পেতে প্রাণে বাঁচিয়াছিলেন৷ শুধু জাগরণ সম্পাদক নহেন বাম শাসনে সাংবাদিকরা আক্রমণের শিকার হইলেও প্রতিকার মিলে নাই৷ এমন ঘটনার অভাব নাই৷ কথায় আছে যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ৷ এই বাম শাসিত ত্রিপুরায় সাংবাদিকদের উপর আক্রমণের ঘটনা নতুন নহে৷ বহু সাংবাদিক বাম ক্যাডারদের হাতে মার খাইয়াছেন৷ প্রতিবাদ হইলেও প্রতিকার হয় নাই৷ আজ সংবাদপত্র নতুন করিয়া আক্রমণের মুখে৷ ২০০০ সালে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ত্রিপুরার প্রথম দৈনিক জাগরণ প্রকাশনা বন্ধ করিবার ঘোষণা দেওয়া হইয়াছিল৷ সে সময় বিধানসভায় তথ্যমন্ত্রী জীতেন্দ্র চৌধুরী পত্রিকাকে বাঁচাইয়া রাখিতে প্রয়াস নিবার কথা ঘোষণা করিয়াছিলেন এবং জাগরণ সম্পাদকের সঙ্গে এই বিষয়ে বৈঠকও করেন৷ সেই বৈঠকে তথ্য অধিকর্তা, সচিব ছাড়াও তৎকালীন বিশিষ্ট সাংবাদিক পারিজাত দত্ত জাগরণ সম্পাদকের অনুরোধে উপস্থিত ছিলেন৷ পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধের ঘোষণাও তখন তুলিয়া নেওয়া হইয়াছিল৷ আবার সেই কঠিন পরিস্থিতির মুখে রাজ্যের অধিকাংশ সংবাদপত্র৷ গোটা দেশ জুড়িয়া ছোট সংবাদপত্রের সামনে দূর্যোগ নামিয়া আসিয়াছে৷ বহু ক্ষুদ্র সংবাদপত্র প্রকাশনা বন্ধ হইয়া গিয়াছে৷ অনেক বেশী প্রচার সংখ্যার অধিকারী সংবাদপত্রও ঝাপ ফেলিতে বাধ্য হইয়াছে৷ বহু সংবাদপত্র কর্মী রুটি রুজি বন্ধ হইয়া এক বিপর্য্যয়কর পরিস্থিতির সামনে হাবুডুবু খাইতেছেন৷ কোনও কোনও ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সংস্কারের কারণে সমস্যা হাজির হইয়াছে৷ এই উদ্ভুত পরিস্থিতির মুখে ত্রিপুরার সর্বপ্রাচীন দৈনিক ‘জাগরণ’ ভবিষ্যত শংকার মুখে দাঁড়াইয়া গিয়াছে৷ ৬৪তম বছরের পদার্পন মুহুর্তে, অর্থাৎ জন্মদিনে আনন্দঘন, আবেগ মথিত পরিস্থিতি নাই৷ কোনও জন্মদিনেই এই সৌভাগ্যের দেখা মিলে নাই৷ গভীর শংকা, প্রতিনিয়ত মৃত্যুর পদধবনির মাঝেই বাঁচিয়া থাকার প্রাণপন লড়াই জারী আছে৷ এই যখন পরিস্থিতি তখন আত্ম বিশ্লেষণের অনেক বেশী প্রয়োজন৷ অসত্য পথে বিচরণ, অসদাচরণ, নীতি আদর্শের তোয়াক্কা না করিয়া অর্থের পিছনে ছুটিয়া যাওয়ার কারণে সংবাদপত্রের গৌরব ধুলায় লুটাইয়াছে৷ মানুষের বিশ্বাস হারাইয়াছে৷ যে সংবাদপত্র আর্তের সেবায় ছিল অগ্রণী সেই সংবাদপত্রে লোভ লালসার বেদী মূলে আত্ম বিসর্জনের ঘটনা আমাদের লজ্জিত ও বিড়ম্বিত করিয়াছে৷ একথা জনস্বীকৃত যে, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদপত্র৷ শক্তিশালী গণতন্ত্রই শক্তিশালী দেশ গড়িতে পারে৷ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যদি ক্ষুন্ন হয় তাহা হইলে গণতন্ত্রও দুর্বল হইতে বাধ্য৷ আজ বৃহৎ পঁুজির মালিকরাই সংবাদপত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ চালু রাখিয়াছে৷ সরকারী ভাবেও পৃষ্টপোষকতা পাইতেছে এই কর্পোরেট সংবাদপত্রগুলি৷ যেন মাৎস্যন্যায় চলিতেছে৷ ক্ষুদ্র সংবাদপত্রের বিকাশ ও প্রসারের জন্য সরকারী স্তরে কোনও প্রকল্প নাই৷ ফলে, তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়ার সম্ভাবনাই বাড়িতেছে৷ স্থানীয় বা আঞ্চলিক স্তরে বঞ্চনা ও অভাব অভিযোগ এই কর্পোরেট সংবাদপত্রে স্থানই পায় না৷ দেশের বড় বড় সংবাদপত্রগুলি ক্ষুদ্র ও প্রত্যন্ত রাজ্যের সংবাদ প্রকাশে উৎসাহী যে নয় তাহার বহু প্রমাণ রহিয়াছে৷ ক্ষুদ্র ও আঞ্চলিক সংবাদপত্রের মৃত্যু হইলে গ্রাম ভারতের সমস্যা নিয়া কথা বলিবে কে? গ্রামীণ সমস্যা মাটি চাপা পড়িবে৷ শোষণ নিপীড়নের নাগপাশে বন্দীদশায় থাকা মানুষ কোথায় দাঁড়াইবে? এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করিতে কেন্দ্রের সরকার সত্যিই কি অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারিবে? ত্রিপুরার প্রথম দৈনিক ‘জাগরণ’ ৬৪তম জন্মদিনে ক্ষুদ্র সংবাদপত্রের ভবিষ্যত সুরক্ষার প্রশ্ণে কেন্দ্রীয় সরকারকে নতুন করিয়া ভাবিবার আর্জি জানাইতেছে৷ ‘ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’৷ এই স্বপ্ণকে সার্থক করিতে ক্ষুদ্র সংবাদপত্রগুলি বিরাট ভূমিকা নিতে পারে৷
এক সময় সংবাদপত্র প্রকাশনায় যে মানসিক দৃঢ়তা ছিল আজ তাহা আর কতখানি আছে৷ স্বীকার করিতেই হইবে সংবাদপত্র বা প্রচার মাধ্যমকেও অবক্ষয় গ্রাস করিয়াছে৷ এমন অনেক এই মাধ্যমে যুক্ত হইয়াছেন যাহাদের হাত কলংকিত৷ তাহারাই এখন মিডিয়ার মধ্যমণি৷ ফলে, সংবাদপত্র বা মিডিয়ার যে স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল ভাবমুর্তি ছিল তাহা অনেকটাই ধুলায় লুটাইয়াছে৷ পেইড নিউজ, কোনও দলের হইয়া দালালী ইত্যাদির ঘটনায় লজ্জিত, মর্মাহত হইয়া কতখানি চলার পথে শক্তি পাওয়া যায়? প্রাচীন এই দৈনিক জাগরণ ৬৪তম জন্মদিনে লেখক পাঠক পাঠিকা গ্রাহক ও বিজ্ঞাপন দাতাদের কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাইতেছে৷ তাঁহাদের সহযোগিতায় ত্রিপুরার প্রথম দৈনিক ৬৪ তম বছরে শুভ যাত্রা শুরু করিল৷ বহু বন্ধুর পথে বহুকাল এই পত্রিকা আগাইয়া যাইবার অঙ্গীকার ঘোষণা করিতেছে৷ আশা করা যাইতে পারে কঠিন লড়াইয়ে পরীক্ষিত জাগরণ একদিন সাফল্যের চুড়ায় উঠিতে পারিবে৷ মানুষের পদপ্রান্তে আমাদের প্রণতি৷ মানুষই শক্তি, মানুষই ভগবান৷ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’৷ মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসায় সত্য ও স্বচ্ছতার অঙ্গীকারে ‘জাগরণ’ দারিদ্রকে সাথী করিয়া বাঁচিয়া আছে৷ বারবার কঠিন পরীক্ষায় উত্তির্ণ হইয়াছে৷ আগামী দিনে ভয়াল সংকটের মুখেও জাগরণ নতুন প্রতিজ্ঞায় ভাস্বর হইয়া উঠিবে, এই প্রত্যাশা করা যাইতেই পারে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *