ধর্মের নামে ভন্ডামী

ধর্মের আড়ালে বা বিভিন্ন সেবার নামে যে কী ভয়ানক কান্ডকীর্তি ঘটিতেছে তাহা আবার চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল৷ ধর্ষণ মামলায় আদালতের রায়ে স্বঘোষিত ধর্মগুরু গুরমতি রাম রহিম সিং দোষি সাব্যস্ত হওয়ায় তাহার শিষ্যরা তান্ডব চালায়৷ আশঙ্কা ছিল আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হইতে পারে৷ তবে, তাহা যে একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যাইবে এমন ধারণা পুলিশের ছিল না৷ ধর্ষণ মামলায় বিশেষ সিবিআই আদালতে স্বঘোষিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং দোষি সাব্যস্ত ঘোষণা হইতেই পাঞ্জাব, হরিয়ানা সহ দিল্লীর কিছু অংশে ব্যাপক হিংসা ছড়াইয়া পড়ে৷ ভয়ংকর তান্ডব চালাইল ডেরা সাচা সৌদার নেতা রাম রহিমের অনুগামীরা৷ পুলিশ ও তান্ডবকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের বলি হইয়াছে ত্রিশজনের বেশী৷ আহত অন্তত ২৫ জন৷ সবচাইতে বেশী হিংসা ছড়ায় পাঁচকুলায়৷ আক্রান্ত হয় সংবাদ মাধ্যমও৷ অশান্তির দায়ে আটক রাম রহিমের এক হাজার ভক্ত৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করিয়াছেন৷ তিনি নিজে নিরাপত্তা আধিকারীকদের ডাকিয়া পরিস্থিতি পর্যালোচনা করিয়াছেন৷ শুক্রবার বিকাল পৌণে তিনটা নাগাদ হরিয়ানার পাঁচকুলার বিশেষ সিবিআই আদালত রাম রহিমকে ধর্ষণ মামলায় দোষি সাব্যস্ত করে৷ ১৯৯৯ সালে দুই শিষ্যাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে রাম রহিমের বিরুদ্ধে৷ ২০০২ সালে সিবিআই তাঁহার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে৷ বেনামী চিঠিই যে এই বর্ণময় চরিত্রের রাম রহিমের জীবনে এমন ভয়ানক দুর্যোগ নিয়া আসিবে তিনি হয়তো তাহা ধারণা করিতে পারেন নাই৷ ২০০২ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে বেনামী চিঠি লেখেন এক সাধবী৷ চিঠি দেওয়া হয় দুই রাজ্যের সরকার, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, সিবিআই ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকেও৷ এই চিঠিতে সাধবী জানান কিভাবে ধর্মগুরু তাহাকে ধর্ষণ করিয়াছেন৷ চিঠিতে তিনি জানাইয়াছেন, তিনি একা নন আরও অনেক শিষ্যা তাঁহার লালসার শিকার হইয়াছেন৷ নড়িয়া চড়িয়া বসে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট৷ আদালতের নির্দেশে তদন্তের ভার যায় সিবিআইয়ের হাতে৷ তদন্তে নামিয়া বেনামি চিঠির লেখিকাকে খঁুজিয়া বাহির করে সিবিআই৷ তাঁহার গোপন জবানবন্দীও দেয় আদালতে৷ শেষ পর্য্যন্ত অভিযুক্ত রাম রহিমকে দোষি সাব্যস্ত করে আদালত৷
রাম রহিমের আশ্রমে শিষ্যাদের উপর পাশবিক লালসা মেটানোর এই ঘটনা যখন আদালতে প্রমাণ হইয়া গেল তখন শিষ্যরা এমন উন্মত্ত তান্ডব চালাইল কোন্ নীতি বা আদর্শের তাগিদে৷ আজ এই প্রশ্ণটিই সবচাইতে বড় হইয়া দেখা দিয়াছে৷ ভক্তদের অন্ধ ধারণা যে তাঁহাদের গুরুর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অসত্য৷ গুরুর প্রতি এমন অন্ধ আনুগত্য, বিশ্বাস থাকিতেই পারে৷ কিন্তু, আদালতের রায়কে সম্মান না জানানোর ঘটনা তো বিচার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানো৷ মানুষ নিরুপায় হইয়াই প্রকাশ্যে মুখ খুলিতে পারে না৷ প্রাণের ভয়তো আছেই৷ সেখানে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ ও তদন্ত প্রক্রিয়া শুরুর ঘটনার পরবর্তী পর্যায়ে ধর্মগুরুর মুখোশ খুলিয়া গেল৷ ধর্মগুরুর আশ্রমে শিষ্যাদের উপর পাশবিক লালসা চরিতার্থ করার ঘটনা যে সাংবাদিক প্রচার করিয়াছিলেন তাহাকে খুন করিয়া ফেলা হইয়াছে৷ ধর্মগুরু রাম রহিম এমনই প্রভাবশালী যে তিনি সরকার হইতে জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা পাইতেছেন৷ তিনি কোথাও সফরে গেলে অন্তত দুইশত গাড়ীর কনভয় ছুটিত৷ শুক্রবার আদালতে আসার সময় দুইশত গাড়ীর কনভয় ছিল৷ যদিও আদালত চত্বরে দুইটির বেশী গাড়ী প্রবেশের অনুমতি ছিল না৷
ভারত মুণিঋষিদের দেশ৷ গেরুয়া রঙ শান্তির অহিংসার প্রতীক৷ কিন্তু, চরম দুর্ভাগ্যের এখানেই যে, ধর্মের নামে মানুষ ঠকানো, বিপুল ধন সম্পদের অধিকারী হওয়ার পিছনে ছিল দুস্কর্মের পথে যুক্ত হওয়া৷ মানুষ প্রশাসনের চোখে ধুলা দিয়া যে বেশীদিন থাকা যায় না তাহা বার বার প্রমাণিত হইয়াছে৷ ধর্ষিতা সাধবী প্রশাসনের উচ্চস্তরে চিঠি লিখিয়া ন্যুনতম ভূমিকাও দেখিলেন না৷ কিন্তু, হাইকোর্ট নড়িয়া চড়িয়া বসায় এতবড় অপরাধীকে সনাক্ত করা সম্ভব হইল৷ রাম রহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ও দোষি সাব্যস্ত করার ঘটনা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের চোখ খুলিয়া দিবার কথা৷ যেকোনও ধর্মীয় আশ্রমের উপর কঠোর নজরদারী রাখা খুব জরুরী৷ রাম রহিমের সঙ্গে প্রশাসনের যোগাযোগ যে ছিল তাহা তো নানা ঘটনায় প্রমাণিত৷ শুধু রাম রহিম নহে বিভিন্ন ধর্মীয় আশ্রম বা গুরুদেবের উপর নজরদারী চালু রাখিতেই হইবে৷ ধর্মের প্রতি অবিচল মানুষের দূর্বল চিত্তকে নানা ভাবে এই দুষ্ট গুরুরা ব্যবহার করে৷ সাধু সন্তদের দেশ ভারতের ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে ভন্ড গুরুদের খঁুজিয়া বাহির করিতেই হইবে৷ গেরুয়া বসন নিয়া ভন্ডামীর মুখ যেখানেই চলিবে সেখানেই চরম আঘাত হানিতে হইবে৷ তাহা না হইলে ধর্মের প্রতি মানুষের চরম বিশ্বাস একদিন হারাইয়া যাইবে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *