নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৩ জুন৷৷ রোজভ্যালী চিটফান্ড কান্ডে সিবিআই জেরার মুখোমুখি হতে চলেছেন রাজ্য সরকারের
সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী বিজিতা নাথ৷ আগামী ২৯ জুন সকাল দশটায় তাঁর সরকারী বাসভবনে সিবিআই তাঁকে রোজভ্যালী মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে নোটিশ পাঠিয়েছে৷
সূত্রের খবর, কলকাতাস্থিত সিবিআই কার্যালয়ের অফিসার ব্রতিণ ঘোষাল শুক্রবার সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী বিজিতা নাথকে ১৬০ সিআরপিসি ধারায় নোটিশ পাঠিয়েছেন৷
সূত্রের খবর, সিবিআই’র নোটিশে বলা হয়েছে, আপনাকে এই মর্মে অবগত করা হচ্ছে যে, নিম্নে উল্লেখিত মামলার প্রাসঙ্গিকতায়, আমি এই মামলার তদন্ত করছি৷ কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওর এর চ্যাপ্ঢার ১২ এর অধীন, আপনাকে জানানো হচ্ছে, ২৯ জুন ২০১৭ সকাল ১০টায় আপনার আগরতলাস্থিত সরকারী আবাসনে উপস্থিত থেকে উক্ত মামলার প্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্ণের উত্তর দেওয়ার জন্য৷
নোটিশে মামলার বিবরণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সিবিআই/ইও-চার/কলকাতা মামলার নম্বর আরসি৩৯(এস)/২০১৪ যা রুজু করা হয়েছে আইপিসি’র ৪২০/ ৪০৮/৪০৯/১২০-বি এবং ৩৪ ধারা মোতাবেক এবং প্রাইজ চিটস এন্ড মানি সার্কুলেশন স্কিমস(ব্যানিং) এ্যক্ট ১৯৭৮ এর ৪, ৫ এবং ৬ ধারা মোতাবেক রোজভ্যালী হোটেল এন্ড এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেড এর চেয়ারম্যান ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে নথিভুক্ত মামলা৷
চিটফান্ড কান্ডে সিবিআই তদন্তের দাবিতে বিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন৷ ২০১৩ সালে রাজ্য সরকার চিটফান্ড সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে তাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে বলেও অভিযোগ৷ রাজ্যে মোট ১৪ লক্ষ আমানতকারীর অর্থ লুটে পালিয়েছে চিটফান্ড সংস্থাগুলি৷ রাজ্য সরকার চিটফান্ড কান্ডে সিবিআই’র কাছে যতগুলি মামলা পাঠিয়েছিল এর মধ্যে পাঁচটি মামলা তদন্তের জন্য গ্রহণ করেছিল সিবিআই৷ এনিয়েও বিরোধীদের অভিযোগ রোজভ্যালীর মামলার পরিমান কম দেখানো হয়েছে, এরজন্যই সিবিআই এই সংস্থাটির বিরুদ্ধে তদন্ত করতে রাজী হয়নি৷ কিন্তু, সেই রোজভ্যালীর বিরুদ্ধে মামলার তদন্তেই সিবিআই এবার রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যা বিজিতা নাথকে জেরা করবে৷
তাঁর বিরুদ্ধে চিটফান্ড সংস্থার পক্ষে জনগণকে উৎসাহিত করার অভিযোগ রয়েছে৷ বিরোধীদের দাবি, তিনি নিজে চিটফান্ড সংস্থার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন৷ মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে একাধিক চিটফান্ড সংস্থার অনুষ্ঠানে গিয়েছেন এবং ভাষণে তাদের ঢালাও প্রশংসা করেছেন৷ বিরোধীদের আরও অভিযোগ, শাসক দলের মদতেই রাজ্যে চিটফান্ড সংস্থাগুলি বেড়ে উঠেছিল৷ কারণ, কোন কাগজপত্র যাচাই না করেই বিভিন্ন চিটফান্ড সংস্থাকে রাজ্যে ব্যবসা করার জন্য ট্রেড লাইসেন্স রাজ্য সরকারই দিয়েছে৷ এদিকে, তাদের পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও রাজ্য সরকার এবং শাসক দল মদত দিয়েছে বলেও অভিযোগ৷ ২০১৩ সালে সদর মহকুমা শাসকের নেতৃত্বে অভিযানে রোজভ্যালীর এক অধিকর্তা অশোক সাহা এবং ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার অনুপম ভট্টাচার্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ বহু নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল৷ সাথে আগরতলা সহ সারা রাজ্যে রোজভ্যালীর সমস্ত অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল প্রশাসন৷ অবশ্য পরবর্তী সময়ে অশোক সাহা এবং অনুপম ভট্টাচার্য জামিনে ছাড়া পেয়ে যান৷ অশোক সাহা এরপর রাজ্য থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন৷ পরে অবশ্য তিনি কলকাতায় সিবিআই তাকে আটক করেছে৷ বর্তমানে তিনিও সিবিআই হেফাজতে রয়েছেন৷
উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে রোজভ্যালীর শাখা প্রসারিত হয়েছিল সেই রাজ্যগুলিকে পক্ষভুক্ত করে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল সিবিআইকে৷ এরই জেরে পশ্চিমবঙ্গে ধরপাকড় শুরু করে সিবিআই৷ সংস্থার কর্ণধার গৌতম কুন্ডু বর্তমানে সিবিআই হেফাজতে রয়েছেন৷
এরাজ্যে চিটফান্ড ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছিল৷ রোজভ্যালী ছাড়াও বেসিল, সারদা সহ বহু চিটফান্ড সংস্থা ঝাকিয়ে বসেছিল৷ এই চিটফান্ড সংস্থায় টাকা রেখে বহু মানুষ পথে বসেছে৷ রাজ্য থেকে চিটফান্ড সংস্থাগুলি যখন পাততারি গুটিয়ে পালিয়ে যায়, এরপর বিরোধী দল কংগ্রেস আমানতকারীদের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়া এবং চিটফান্ড সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হয়৷ দিল্লির যন্তর মন্তরে ধর্ণা এবং রাষ্ট্রপতির দরবারে সিবিআই তদন্তের দাবিও জানানো হয়েছে৷ বিধানসভায় একাধিকবার বিরোধী দলের সদস্যরা রাজ্য সরকারকে চিটফান্ড ইস্যুতে বিধেছেন৷ সিবিআই তদন্ত নিয়ে টালবাহানার জন্য বহুবার রাজ্য সরকার সমালোচিত হয়েছে৷
সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশে চিটফান্ড তদন্তে সিট গঠিত হয়েছে৷ সিট’র অফিসাররা তদন্ত শুরু করেছে৷ তাতে, বেশ কয়েকটি চিটফান্ড সংস্থার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে৷ গত কিছুদিন আগে আমতলিস্থিত রোজভ্যালী পার্কে তালা লাগিয়ে দেয় প্রশাসন৷
এই সমস্ত প্রক্রিয়া শুরু হলেও চিটফান্ড কান্ডে সিবিআই’র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ণ উঠতে শুরু হয়েছিল৷ কারণ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ওড়িশাতে সিবিআই হানা দিলেও, রোজভ্যালী ইস্যুতে ত্রিপুরার দিকে তারা নজর দিচ্ছিল না৷ বিরোধীদের বক্তব্য, গোটা দেশের মধ্যে রোজভ্যালী সবচেয়ে বেশি এরাজ্যে ব্যবসা করেছে৷ সবচেয়ে বেশি টাকা এরাজ্য থেকে নিয়ে পালিয়েছে৷ অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সত্বেও সিবিআই এরাজ্যের দিকে কেন নজর দিচ্ছে না, তা নিয়ে একাধিক প্রশ্ণ উঠেছে৷
কিন্তু, সম্প্রতি বিজেপি রাজ্য প্রভারি সুনীল দেওধর জোর গলায় দাবি করেছিলেন দূর্গোৎসবের আগেই এরাজ্যে সিবিআই হানা দেবে৷ তিনি জানিয়েছিলেন, এরাজ্যে রোজভ্যালী সংক্রান্ত সমস্ত দস্তাবেজ সিবিআই’র কাছে পাঠানো হয়েছে৷ এই ঘোষণার অল্প দিনের মধ্যেই রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্যা বিজিতা নাথকে গতকাল সিবিআই’র পাঠানো নোটিশকে ঘিরেও বিতর্ক দেখা দিয়েছে৷
এদিন এবিষয়ে রাজ্যের আইন মন্ত্রী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, কেন্দ্রের শাসক দল আগেও বহুবার সিবিআই’কে নানা ভাবে ব্যবহার করেছে তার বহু উদাহরণ আছে৷ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিজন ধর বলেন, সিবিআই চাইছে রোজভ্যালী মামলা রাজ্যের মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে৷ তাতে আপত্তির কিছুই নেই৷ তবে, তাতে সিবিআই’কে শাসক দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা এই প্রশ্ণে তাঁর জবাব, এখনই সেবিষয়ে কিছু বলার সময় আসেনি৷ তৃণমূল বিধায়ক সুদীপ রায় বর্মন বলেন, চিটফান্ড কান্ডে সিবিআই দাবি দীর্ঘদিনের৷ অবশেষে সিবিআই রাজ্যে তদন্ত শুরু করছে৷ তবে, আমানতকারীদের আমানত ফিরিয়ে দেওয়া হউক, সেবিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে৷