শক্তির মহড়া বিজেপির

অন্দোলন করিতে জোরাদার ইস্যুর চাইতেও প্রয়োজন বড় সাংগঠনিক শক্তি৷ চার মার্চ রাজ্যের ৬২টি স্থানে আইন অমান্য আন্দোলন করিয়া বিজেপি দেখাইতে পারিয়াছে লোকবল তাহাদের বাড়িয়াছে৷ বুঝাইয়া দিয়াছে, তাহারাই ত্রিপুরায় প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানে অভিষিক্ত হইতেছে৷ আইন অমান্যে ছত্রিশ হাজার নেতা কর্মীর গ্রেপ্তার এবং পুলিশ সহ কুড়ি জনের জখম হওয়ার ঘটনা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছে গেরুয়া পার্টি আজ অনেক বেশী অগ্রসর৷ গন্ডাছড়ার বিজেপি নেতা বা কর্মী চাঁনমোহন ত্রিপুরার হত্যার ঘটনা নিয়া দল জোর আন্দোলনে নামিয়াছে৷ সিবিআই তদন্তের দাবীকে সামনে রাখিয়া আইন অমান্য করিয়াছে৷ এই আইন অমান্য আঠারো সালের বিধানসভা নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি বড় অভিযান, শক্তি পরীক্ষা দেওয়া হইয়া গেল বিজেপির৷ কিন্তু প্রশ্ণ উঠিয়াছে, যে নির্বাচনের লক্ষ্যে এত তোড়জোর সেখানে কাঙ্খিত লাভালাভ হইবে কিনা৷ তৃণমূল কংগ্রেসও ঘোষণা দিয়াছে, তাহারাও বামফ্রন্টকে হঠাইতে কোমড় বাধিয়া নামিয়া পড়িবে৷ দল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মে মাসে রাজ্য সফরে আসিবেন৷ ইতিমধ্যেই আসিবেন দলের সাংসদ মুকুল রায়৷ তৃণমূল নেতারা ভাল করিয়াই জানেন বিজেপি তাঁহাদের চোখের ঘুম কাড়িয়া নিয়াছে৷ অবাম সবগুলি দলের নেতারা ভাল করিয়াই জানেন ভোট ভাগাভাগির কারণে ‘বাম হঠানোর স্বপ্ণ’ স্বপ্ণই থাকিয়া যাইবে৷ কিন্তু, কি করিয়া ‘বাম ঐক্য’ গড়িয়া তোলা যাইবে সেই ফর্মুলা তো এখনও অজ্ঞাতই রহিয়া গিয়াছে৷ কারণ, রাজনীতির ক্ষেত্রেও বাধ্যবাধকতা আছে৷ এ রাজ্যে তৃণমূল নেতারা যতোই জোট গঠনের জন্য উদগ্রীব হউন না কেন আসলে সেখানে দলনেত্রী কতখানি অনুমোদন দিতে পারিবেন? পশ্চিমবঙ্গে দলের সর্বনাশ হইবে এমন কাজকে তো তৃণমূলনেত্রী অনুমোদন দিতে পারেন না৷
সুতরাং বলিতে দ্বিধা নাই, ত্রিপুরার অবাম জোট গড়িতে না পারিলে যেমন সিপিএম হঠানো কোনমতেই সম্ভব নহে তেমনি জোট গড়িতেও সমস্যা আছে৷ গোপনে আসন সমঝোতার প্রচারও তৃণমূলের রাজনৈতিক বিপদ ডাকিয়া আনিতে পারে৷ একথা বলা যাইতে পারে, ত্রিপুরায় আঠারোর নির্বাচনে ক্ষমতার পালা বদল না হইলেও সিপিএম বা বামফ্রন্টের সেই সুখের রাজত্ব থাকিবে না৷ কারণ যেভাবে গেরুয়া শিবির শক্তি সংহত করিতেছে তাহাতে প্রতিনিয়ত চাপ বাড়িবে৷ চার মার্চ রাজ্যের ৬২ স্থানে আইন অমান্য অন্দোলন সংঘটিত করিয়া বিজেপি বুঝাইয়া দিয়াছে তাহারা ত্রিপুরায় এখন আর বসিয়া বসিয়া মার খাইবেন না৷ ত্রিপুরার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মানুষ কি শেষ পর্য্যন্ত বিজেপিকে অবলম্বন করিতে আগ্রহী? যে ত্রিপুরায় ছিল দুটি মাত্র রাজনৈতিক শক্তি৷ কংগ্রেস ও কমিউনিষ্ট৷ কংগ্রেস তো প্রায় নিশ্চিহ্ণের পথে৷ আর কমিউনিষ্ট পার্টি বা সিপিএম এক সময় জাতীয় রাজনীতিতে ছড়ি ঘুরাইয়াছে৷ আজ এই দল তো একেবারেই ক্ষীণবল হইয়াছে৷ জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতাই হরাইতেছে৷ এই যখন অবস্থা তখন ত্রিপুরার সিপিএম যে শিকড় পরিব্যাপ্ত করিয়াছে তাহা যদি উপড়াইয়া ফেলিতে হয়, সেখানে সেই তেজী আন্দোলন জারী রাখিতে হইবে৷ পরিযায়ী পাখীর মতো ভোটের আগে হাজির হলেই জনগণেশের মন জয় করা যাইবে না৷ সিপিএম ক্যাডার ভিত্তিক দল৷ বিজেপিও সেই পথেরই অনুসারী৷ কত যে শাখা প্রশাখা আছে ক’জন তাঁহার ভিতরে যাইতে পারে৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজেপির হাত আছে, বিচরণ আছে৷ বিজেপি’র এইসব ‘কান্ডকীর্তি’ বলিবার প্রাসঙ্গিকতা এইখানেই যে, এই দল একসময় এই ত্রিপুরায় ছিল সাইনবোর্ড সর্বস্ব৷ আজ কি মহীরুহ হইতে চলিয়াছে? এক সময় কেন্দ্রে ইউপিএ বা কংগ্রেস সরকারকে সিপিএম সমর্থন দিয়া টিকাইয়া রাখিয়াছিল বিজেপিকে রুখিবে বলিয়া৷ আসলে, বিজেপি রোখা নয়, নিজেদের সুবিধা নিংড়াইয়া নেওয়া৷ বিজেপিকে রোখা দূরের কথা বরং এই দল আরও বেশী শক্তি নিয়া অন্যদের রুখিয়া দিতেছে৷ উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল দেশের রাজনীতিকে নতুন খাতে প্রবাহিত করিতে পারে৷ যদি বিজেপি উত্তর প্রদেশ দখল করিতে পারে তাহা হইলে যে রাজনৈতিক ঝড় উঠিবে সেখানে অনেক দলেরই উড়িয়া যাওয়ার আশংকা রহিয়াছে৷ ত্রিপুরায় চার মার্চ আইন অমান্য আন্দোলনে যে জনগণের অংশ গ্রহণ, গ্রেপ্তারের ঘটনা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন করিয়া ভাবনা তো আসিবেই৷ ত্রিপুরায় বহু গণআন্দোলন হইয়াছে৷ বাম আমলে কংগ্রেসও বিরোধী আসনে কোনও দিন তেমন ঝড় তুলিতে পারে নাই৷ কারণ, কংগ্রেসের হাইকমান্ডের সঙ্গে সিপিএম দীর্ঘদিন গোপন বুঝাপড়া চালাইয়া গিয়াছে৷ রাজ্যে কংগ্রেস নিশ্চিহ্ণ হইয়াছে, জন আস্থা হারাইয়াছে হাইকমান্ডের বাম প্রীতির কারণে৷ রাজ্যের মানুষ বিশ্বাস করে অন্তত বিজেপি সিপিএম আঁতাত কোনও দিন হইতে পারে না৷ বাম বিরোধী মানুষ তাই এই গেরুয়া দলকেই নির্ভরযোগ্য ভাবিতেছে৷ আইন অমান্য আন্দোলনে জন অংশ গ্রহণ তাহারই ফলশ্রুতিতে বলিলে হয়তো ভুল বলা হইবে না৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *