বিমানের বোধোদয়

biman masuভুলের রাজনীতিতে সিপিএম দলের নেতারা যে অনেক বেশী অগ্রসর তাহা বারবার প্রমাণিত হইয়াছে৷ ঐতিহাসিক ভুল কতবার হইয়াছে তাহা এক ধাক্কায় বোধহয় বলিয়া দেওয়া যাইবে না৷ জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রীর তখতে বসিতেনা দেওয়া, দলের পরিলটব্যুরোর সিদ্ধান্ত যে ঐতিহাসিক ভুল ছিল তাহা জ্যোতি বসু বলিয়া গিয়াছেন৷ নেতাজি সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে মুল্যায়নের ক্ষেত্রেও এই দলটি কার্যত দ্বিচারিতার ভূমিকাতেই রহিয়া যাইতেছে৷ যেখানে জ্যোতি বসুই বলিয়া গিয়াছেন নেতাজি সুভাষকে আমরা ভুল বুঝেছিলাম৷ এই ভুল বুঝিতে জ্যোতিবাবুদের সময় লাগিয়াছিল ত্রিশ বছর৷ এখন আবার সিপিএম নেতারা সুভাষচন্দ্রের মুল্যায়ণ সম্পর্কে বলিতেছেন, তাহারা পূর্বের অবস্থানেই আছেন৷ অর্থাৎ সুভাষচন্দ্র সাম্রাজ্যবাদের দালাল, একথাটাই আবার প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা হইতেছে৷ কোনটা ভুল, কোনটা শুদ্ধ তাহা নিয়া সিপিএম নেতাদের মধ্যে যে দ্বন্ধ তাহা সাধারণ মানুষের চোখে এড়াইয়া যাইতেছে না৷ আমেরিকার সাথে ভারতের পরমাণু চুক্তি বিরোধীতা করিয়াই সিপিএম ক্ষান্ত হয় নাই৷ ইউপিএ সরকারের উপর সমর্থন প্রত্যাহার করিয়া কার্যত নিজেদের সর্বনাশকে ত্বরান্বিত করিয়াছে৷ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় আসার পিছনে ইউপিএ সরকারের উপর হইতে সমর্থন প্রত্যাহার করিবার ঘটনা অনেক বেশী সহায়ক হইয়াছে৷ একের পর এক ভুল রাজনীতির যুপকাষ্টে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বলি হইয়া যাইতেছে৷ নোট বাতিলের প্রতিবাদে যেখানে বিরোধী অন্যান্য দলরা বন্ধ রাজনীতির পথে পা বাড়ায় নাই, যেখানে সিপিএম বন্ধ ডাকিয়া আবারো ভ্রান্ত পথে পা বাড়াইল৷ গরীব সর্বহারার দল সিপিএম গরীবের পেটেই লাথি মারিল৷ একদিনের রুটি রুজির বন্ধ হওয়ার অর্থ দাঁড়াইল গরীব মেহনতি মানুষের মুখের গ্রাস কাড়িয়া নেওয়া হইল৷ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও কেরালায় ২৮ নভেম্বর বন্ধ ডাকিয়া সিপিএম জনমনে নিজেদের ভাবমূর্ত্তিকে অনুজ্জ্বল করিয়াছে৷ ত্রিপুরায় ও কেরালায় ক্ষমতার জোরে হয়তো বন্ধে সফল হয়৷ কিন্তু যেখানে ক্ষমতাহীন সেই রাজ্যে বন্ধ প্রত্যাখাত হইয়াছে৷ পশ্চিমবঙ্গে বন্ধে যে সাড়া পাওয়া যায় নাই তাহা খোদ স্বীকার করিয়াছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান কমরেড বিমান বসু৷ তিনি বলিয়াছেন, এই অভিজ্ঞতা হইতে আমরা শিক্ষা নেব৷
গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে সবচেয়ে সহজ আন্দোলন বন্ধ ডাকিয়া দেওয়া৷ এই বন্ধের রাজনীতি সবচেয়ে বেশী সংগঠিত করিয়াছে এই কমিউনিস্ট পার্টিরা৷ বামপন্থীরা যখন ভারত বন্ধ ডাকে তখন বাম প্রভাবিত এলাকা ছাড়া সারা ভারতবর্ষে বন্ধের কোন চিহ্ণ পাওয়া যায় না৷ ইহা বাস্তব৷ মানুষের অনুভূতি এবং ইচ্ছাকে মর্যাদা দেওয়ার সদিচ্ছা বামেদের নাই বলিলেই চলে৷ যদি থাকিত তাহা হইলে নোট বাতিলের প্রতিবাদ করিতে গিয়া বন্ধের রাজনীতিতে জড়াইয়া পড়িত না৷ বিমান বসুর সহজ স্বীকারোক্তি একটা জিনিষ স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে যে বিপদকালে বুদ্ধি নাশ৷ তাহা না হইলে যেখানে মানুষ নোট সংকটের কারণে বড় বেশী সংকটে আছেন, তখন বন্ধ ডাকার অর্থই হইল সমস্যাকে আরও জটিল করিয়া দেওয়া৷ কথায় আছে, গোদের উপর বিষফোঁড়া৷ সারা দেশ জুড়িয়া সাধারণ মানুষ যন্ত্রণাপিষ্ট হইলেও ক্ষোভের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে নাই৷ বিরোধী দলগুলি জনগণের সেন্টিমেন্ট কতখানি বুঝিতে পারিয়াছে সন্দেহ আছে৷ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে আন্দোলনের জোয়ার তুলিতে পারেন, দেশের অন্যান্য স্থানে সেই শক্তি তাঁহার নাই৷ লক্ষ্য করিবার বিষয়, নোট সংকটের কারণে আসমুদ্র হিমাচল কাঁপিয়া উঠে নাই৷ ইহা বিরোধীদের ব্যর্থতা, না জনগণের সহনশীলতা সে বিষয়ে গবেষণা চলিতে পারে৷ তবে, একথা জোরের সাথে বলা যাইতে পারে যে, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে অনেক খানি পিছাইয়া রহিয়াছে৷ পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান তথা বর্ষিয়ান কমিউনিস্ট নেতা বিমান বসু অকপটে স্বীকার করিয়াছেন তাঁহাদের ডাকা ধর্মঘটে সাড়া পাওয়া যায় নাই৷ এই ব্যর্থতা স্বীকারোক্তির মধ্যেই বামফ্রন্টের বন্ধ রাজনীতির শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে৷ বন্ধ রাজনীতির সময় শেষ হইয়াছে৷ এখন সময়ের সঙ্গে বামপন্থীরা যদি হাটিতে না পারেন তাহা হইলে ব্যর্থতার মাঝে দলকে শূন্যতা গ্রাস করিবে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *