BRAKING NEWS

হিংসা ও রক্তের রাজনীতি

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা বাড়িবার কারণে হিংসাত্মক ঘটনা বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক হইতেছে৷ শক্তির অধিকারী ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলের আন্দোলন প্রতিহত করিতে বল প্রয়োগ করিয়া থাকে৷ সেখানেই সংঘর্ষ অনিবার্য হইয়া উঠে৷ আশীর দশকে, এই ত্রিপুরায়, মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীর আমলে রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার ব্যাপ্তি ঘটিয়াছিল৷ তখন একমাত্র বিরোধী দল কংগ্রেস৷ কংগ্রেস সিপিএম কর্মীদের সংঘর্ষে গোটা রাজ্য উত্তপ্ত ও রক্তাক্ত হইয়া উঠিয়াছিল৷ সেই রাজনৈতিক সংঘর্ষই পরবর্তী সময়, ১৯৮৮ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের সূচনা করিয়াছিল৷ রক্ত নদীর ঢেউয়ে ক্ষমতার প্রাসাদ তছনছ হইয়া যায়৷ দীর্ঘ কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যের পতনের বীজ তখনই রোপিত হইয়াছিল৷ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও পেট্রোপণ্যের সংকটের প্রতিবাদে শনিবার রাজ্যব্যাপী তৃণমূল কংগ্রেসের চাক্কাজ্যাম কর্মসূচীকে কেন্দ্র করিয়া ধলাই জেলার হালাহালিতে সিপিএমের সঙ্গে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়৷ ইহাতে দুই দলেরই সাত জন আহত হইয়াছেন৷ অভিযোগ যে, কমলপুর হাসপাতালে ভর্ত্তি হওয়া আহত আন্দোলনকারীদের উপর সিপিএম কর্মীরা হামলাও চালায়৷
একথা ঠিক, বিরোধী দলের আন্দোলন, কর্মসূচী ও তৎপরতা না থাকায় এতদিন রাজ্যে তেমন রাজনৈতিক সংঘর্ষ দেখা যায় নাই৷ কিন্তু, রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস মাথাচাড়া দিতে না দিতেই, কিংবা বলা যায় রাজ্যে আত্মপ্রকাশ করিতে না করিতেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হইয়া উঠে৷ এই ঘটনা হইতে কি ইহাই স্পষ্ট হইতেছে না যে, রাজ্যে বিরোধী দলের উত্থান শাসক দল মানিয়া নিতে পারে না? এইভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দাবাইয়া রাখার প্রবণতা যে গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক তাহা তো নতুন করিয়া বলিবার অপেক্ষা রাখে না৷ ত্রিপুরায় বিরোধী শক্তিকে দাবাইয়া রাখিতে গিয়া অতীতে সিপিএম যে পথ ধরিয়াছিল, এখন কি সেই পথেরই অনুসারী হইতে চলিয়াছে? ত্রিপুরার রাজনৈতিক ইতিহাসে, আন্দোলনের ক্ষেত্রে, সিপিএম অনন্য ভূমিকা রাখিয়াছে৷ আর এই আন্দোলনের মধ্য দিয়াই এই দল উঠিয়া আসিয়াছে৷ ভুলিয়া গেলে চলিবে না যে, কংগ্রেসের নেতাদের ক্ষমতা লুলুপতার সুযোগেই সিপিএম জোট সরকারে যোগ দিয়া কৌশলের রাজনীতি করে৷ সেই শচীন্দ্রলাল সিংহ, ত্রিপুরার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, এরাজ্যে কংগ্রেসের জনক৷ গ্রাম পাহাড় তিনি চষিয়া বেড়াইতেন৷ কমিউনিস্টদের মাথা তুলিতে দেন নাই৷ ইহাই রাজনীতির নির্মম পরিণতি যে, এই শচীন্দ্রলাল সিংহের হাত ধরিয়াই সিপিএম বা বামফ্রন্ট ত্রিপুরার মসনদে প্রথম অভিষিক্ত হয়৷ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সংঘাতের কারণে শচীন্দ্রলাল কংগ্রেস ত্যাগ করিয়া বাবু জগজীবন রামের সিএফডি দলে যোগ দিয়াছিলেন৷ সাতাত্তরে ইন্দিরা পতন, ত্রিপুরায় কংগ্রেস ভাঙ্গিয়া চৌচির হইয়া যায়৷ তখন শচীন্দ্রলাল সিংহের সিএফডি ও বামফ্রন্ট মিলিয়া জোট সরকার গঠন করে৷ যদিও এই সরকারগুলি ছিল একেবারেই ক্ষণস্থায়ী৷
কৌশলের রাজনীতির মধ্য দিয়া ত্রিপুরায় ১৯৭৮ সালে বিপুল আসনে জয়ী হইয়া প্রথম ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়৷ বামেদের ক্ষমতায় বসার দুই বছরের মাথাতেই রাজ্যে নজীর বিহীন ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গায় সব তছনছ হইয়া যায়৷ তবু, টানা দশ বছরের বেশী বামফ্রন্ট রাজ্য শাসন করিয়াছে৷ গোটা রাজ্য তখন উগ্রপন্থীদের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছিল৷ বামফ্রন্টের এই দীর্ঘ শাসনে তো শান্তির অস্তিত্ব ছিল না৷ উগ্রপন্থীদের বন্দুকের মুখে রাজ্য চলিত৷ ১৯৮৭ সাল হইতে কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ন হইয়া রাজ্য জুড়িয়া আন্দোলনের গরম হাওয়া বহাইয়া দেয়৷ তখন প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক সংঘর্ষ চলিয়াছে রাজ্য জুড়িয়া৷ বহু রাজনৈতিক কর্মীর অকাল মৃত্যু হয়৷ হত্যার রাজনীতির হাত ধরিয়া রাজ্যে বিরোধী শক্তির উত্থান ঘটিতে থাকে৷ ১৯৮৮ সালে কংগ্রেস যুব সমিতি জোট ক্ষমতায় আসে৷ কিন্তু জোট নেতৃত্বের কান্ড কীর্তিতে অতীষ্ট ত্রিপুরাবাসী আবার বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় বসায়৷ যদিও অভিযোগ আছে যে, কেন্দ্রে নরসীমা রাওয়ের কংগ্রেস সরকার বাঁচাইবার জন্য গোপন সমঝোতার মাধ্যমে ত্রিপুরায় আবার বাম রাজত্বের অভিষেক হয়৷
এই রাজনৈতিক ইতিহাসের এখানে প্রাসঙ্গিকতা এই জন্য যে, বিরোধী শক্তিকে বেশী দিন দাবাইয়া রাখা যায় না৷ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি কোমড় বাঁধিয়া ময়দানে নামিয়াছে৷ নয়ই আগষ্ট তৃণমূলনেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগরতলায় বিশাল সমাবেশে ভাষণ দিবেন৷ একথা ঠিক, আগামী বিধানসভা নির্বাচনের লক্ষ্যে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে নামিয়াই পড়িয়াছে৷ চাক্কা জ্যাম কর্মসূচী যে সেই লক্ষ্য হইতেই তাহা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ খুব স্বাভাবিক ভাবেই সিপিএম তৃণমূলী কর্মকান্ডকে হাসিমুখে মানিয়া নিবে না৷ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে তৃণমূলের আন্দোলনকে তো সমর্থন দেওয়াই উচিত৷ আজকের সময়ে ত্রিপুরা তো বিপন্ন৷ আরও বৃহত্তর আন্দোলনই কাম্য৷ কেন্দ্রীয় সরকার, আসাম সরকার, জাতীয় সড়ক মেরামতির নামে এত দিন ছেলেখেলা চালাইয়া ত্রিপুরাকে বিপর্য্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে৷ সেখানে আন্দোলন তো স্বাভাবিক পরিণতি৷ রাজ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অধিকার কাড়িয়া নিবার মধ্যে তো কোনও মহত্ব, বীরত্ব নাই৷ তাহা নিজের পায়ে কুড়াল মারার সামিল৷ রাজ্যে নতুন শক্তি নিয়া বিরোধী রাজনৈতিক দলের অভিযান যে শুরু হইবে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই৷ যেখানে যদি হিংসার পথ বাছিয়া নেওয়া হয় তাহা হইলে সাধারণ মানুষ ইহাকে বরদাস্ত করিবে না৷ রাজনৈতিক সংঘর্ষ গণতন্ত্রকে দূর্বল করে৷ রক্তের উপর দাঁড়াইয়া রাজনীতি মানুষের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়৷ শনিবার চাক্কাজ্যামকে কেন্দ্র করিয়া হালাহালিতে রক্তাক্ত সংঘর্ষ আগামী দিনের ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকেই রাজনীতিকে নিয়া যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা৷ সময় থাকিতে সব রাজনৈতিক দলগুলিকে সংযত ও শান্তিপূর্ণ পথেই গণআন্দোলনের মাধ্যমে আগাইতে হইবে৷ ইহাই গণতন্ত্রের পথ৷ রক্তাক্ত রাজনীতি গণতন্ত্রের অগ্রগতিতে ব্যাহত করে৷ স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির উত্থানে সহায়ক হয়৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *